মজিবুর রহমান শেখ মিন্টু: বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে সাংবাদিকরা শুধু মামলায় ফাঁসছেন, হুমকির মুখে পড়ছেনই না, অনেকেই প্রাণ পর্যন্ত হারাচ্ছেন। এটা কোনো ব্যক্তিগত ঘটনা নয়, এটা আমাদের স্বাধীন গণমাধ্যম এবং সারা দেশের মানুষকে সংবাদ পাওয়ার অধিকারকে চ্যালেঞ্জ করে। যখন রাষ্ট্র সাংবাদিকদের নিরাপত্তাকে যথাযথ গুরুত্ব দেয় না, তখন ঘটে এমন ভয়াবহ ঘটনা, যা একক সাংবাদিকের মৃত্যু নয়; এটি একটি দেশের গণতন্ত্রের প্রতি আঘাত।
গাজীপুরে দৈনিক প্রতিদিনের কাগজের গাজীপুর প্রতিবেদক আসাদুজ্জামান তুহিনের নির্মম হত্যাকাণ্ড আমাদের সামনে এক করুণ বাস্তবতা এনে দিয়েছে। ৭ আগস্ট ২০২৫ সালের সন্ধ্যায় কাজ শেষে গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে ভিডিও ধারণ করার সময় তাকে আকস্মিকভাবে ধর্ষণ করা হয়, তারপর আশ্রয় নেওয়ার জন্য যাওয়া একটি চায়ের দোকানে ঢুকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। পুলিশ জানিয়েছে, হত্যার মূল কারণ ছিল তার কোনো রাজনৈতিক প্রতিবেদন নয়, চাঁদাবাজি নয়; বরং একটি অবৈধ ছিনতাইকারী চক্রের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব এবং ভিডিও মুছে ফেলার চাপ না মানাই এই নির্মম ঘটনাটির মূল কাহিনী।
আন্তর্জাতিক সাংবাদিক ফেডারেশন (IFJ) এই হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়ে দ্রুত ও স্বচ্ছ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে। এই হত্যাকাণ্ড শুধু একজন সাংবাদিকের জীবনের ক্ষতি নয়, এটা আমাদের সবার জন্য একটি ভয়ঙ্কর বার্তা; যদি রাষ্ট্র সাংবাদিকদের নিরাপত্তাকে গুরুত্ব না দেয়, তাহলে আমরা সবাই হারাবো স্বাধীনতা আর সত্যের আলো।
আমাদের দেশের সাংবাদিকরা যেসব ঝুঁকি নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব হন, জনগণের কণ্ঠস্বর হয়ে দাঁড়ান; তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতা অনেক দূরে সেই লক্ষ্য থেকে।
আমাদের দেশে ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন হওয়ার পর থেকে সাংবাদিকদের ওপর মামলা, গ্রেপ্তার এবং হুমকির মাত্রা বেড়েছে। এই আইনটি সাংবাদিকদের ভয় দেখাতে, তাদের স্বাধীন সংবাদকর্মিতা দমন করতে ব্যবহার হচ্ছে। ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে অন্তত ২২৯ জন সাংবাদিককে এ আইনের আওতায় অভিযুক্ত করা হয়েছে, যার মধ্যে ৫৬ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। ২০২৪ সালের গরমে বিক্ষোভ কভার করতে গিয়ে অন্তত পাঁচ জন সাংবাদিক গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন, আরেকজন পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। শুধু গত এক বছরে ৪৯৬ জন সাংবাদিককে হয়রানি করা হয়েছে; এই সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
সাংবাদিকদের ওপর এসব নির্যাতন ও মামলা ছাড়া আরও ব্যবহার হচ্ছে পুলিশের চাপ, অনলাইনে সেন্সরশিপ, প্রেস আইডি বাতিল, এবং গ্রেফতারের ভয়। আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থাগুলো বারবার সতর্ক করে আসছে; এসব কাজের পেছনে রয়েছে দমননীতির ছায়া, আর অপরাধীদের শাস্তি না পাওয়ায় অপরাধীরা নির্ভয়ে পুনরায় এমন কাণ্ড ঘটাচ্ছে।
রাষ্ট্রের করণীয় প্রথমেই হল- সাংবাদিকদের ওপর হামলা, নির্যাতন, হত্যা; এসব ঘটলে দ্রুত ও স্বচ্ছ তদন্ত নিশ্চিত করা। অপরাধীদের সুষ্ঠু বিচারের আওতায় আনা, নির্যাতিত সাংবাদিকদের পরিবার ও আক্রান্তদের আর্থিক ও মানসিক সেবা দেওয়া। তদন্ত যদি হয় না, তাহলে অপরাধীরা যেন ভয় পায় না, এটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব না।
দ্বিতীয়ত, দমনমূলক আইনগুলোকে সংস্কারের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পর্যায়ে নিয়ে আসা জরুরি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন যেন সাংবাদিকদের ওপর অত্যাচারের হাতিয়ার না হয়, তার জন্য সংশোধন দরকার। বাকস্বাধীনতার জন্য উপযোগী আইন প্রয়োজন।
তৃতীয়ত, সাংবাদিকদের জন্য একটি নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যেখানে তাদের ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য বিশেষ ইউনিট থাকবে, জরুরি হটলাইন থাকবে এবং আহত সাংবাদিকদের জন্য আর্থিক সহায়তা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা থাকবে।
চতুর্থত, সাংবাদিকদের আর্থিক নিরাপত্তা দিতে হবে। সরকারি পক্ষ থেকে নিরাপত্তা ভাতা, স্বাস্থ্য বীমা, দুর্ঘটনা ক্ষতিপূরণ, এবং প্রয়োজনে পেনশন ব্যবস্থা চালু করতে হবে। নিহত বা আহত সাংবাদিকদের পরিবারকে যাতে আর্থিকভাবে নিরাপত্তা দেওয়া যায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
পঞ্চমত, মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকেও দায়িত্ব নিতে হবে। তারা যেন কর্মীদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করে, সাইবার সুরক্ষা ও মানসিক সহায়তা দেয়, ঝুঁকি প্রশিক্ষণ দেয়; এগুলো নিশ্চিত করতে হবে।
সবশেষে, আমাদের রাষ্ট্রের নেতৃত্বকে দায়িত্ব নিতে হবে; সাংবাদিকদের ওপর চলমান হামলা ও দমননীতি বন্ধ করতে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কার জরুরি। যদি রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য সাংবাদিকরা ভুক্তভোগী হন, তাহলে দেশের গণতন্ত্র দুর্বল হবে।
সাংবাদিকরা যদি নিরাপদ না থাকে, তাহলে সাধারণ মানুষও সত্যের আলো থেকে বঞ্চিত থাকবে। আমাদের অবশ্যই এই সত্য মেনে নিয়ে এখনই সুষ্ঠু পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে তুহিনের মতো মেধাবী সংবাদকর্মীরা নিরাপদে কাজ করতে পারে, আর দেশের গণতন্ত্র ও সত্য রক্ষা পায়। আমাদের সাংবাদিকদের জন্য স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই আমাদের সকলের দায়িত্ব।
আপনার মতামত লিখুন :