নিষিদ্ধের ছায়ায় ব্যাটারিচালিত রিকশা

মোঃ আবদুল রহিম , ভ্রাম্যমান সংবাদদাতা

প্রকাশিত: ১৬ মে, ২০২৫, ০৭:৩২ পিএম

একটি রাষ্ট্রের প্রকৃত উন্নয়ন কেবল অবকাঠামো বা বড় প্রকল্পের ওপর নির্ভর করে না; বরং ক্ষুদ্র পেশাজীবী ও দিন আনা-দিন খাওয়া মানুষের কর্মসংস্থানই গড়ে তোলে টেকসই অর্থনৈতিক ভিত। ব্যাটারিচালিত রিকশা-যা পরিবেশবান্ধব, সাশ্রয়ী এবং নগরজীবনে স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য একটি নির্ভরযোগ্য বাহনড়আজ তা যেন পরিণত হয়েছে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের লক্ষ্যবস্তুতে।

সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন এলাকায় এই রিকশার ওয়ার্কশপ ও চার্জিং পয়েন্ট উচ্ছেদ অভিযান শুরুর মাধ্যমে সরকার যেন ঘোষণা দিয়েছে, জীবিকার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এখন প্রশাসনিক নির্দেশনা।

জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে প্রায় ৭ থেকে ১০ লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা চলমান, যেগুলোর সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত অন্তত ২০ লাখ মানুষ। রিকশাচালক, ওয়ার্কশপ শ্রমিক, যন্ত্রাংশ ব্যবসায়ী, চার্জিং স্টেশন মালিক, রিকশা মালিকড়সবার জীবন ও জীবিকা গড়ে উঠেছে এই বাহনের চারপাশে। হঠাৎ করে এই খাতের বিরুদ্ধে দমনমূলক অভিযান কেবল রাস্তাঘাট নয়, অসংখ্য পরিবারকেও করে তুলেছে দিশেহারা।

অবশ্য অভিযোগেরও শেষ নেই-অননুমোদিত রিকশা, অবৈধ চার্জিং, নিম্নমানের ব্যাটারি, ট্রাফিক বিশৃঙ্খলা। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সমস্যার দায় শুধুই কি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর? তারা কি নিজের ইচ্ছায় বেআইনি পথে এসেছে, নাকি রাষ্ট্রীয় নীতির অনুপস্থিতি ও দুর্নীতিগ্রস্ত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাই তাদের এ পথে ঠেলে দিয়েছে? যাঁরা বৈধভাবে এসব বাহন দেশে আমদানি করেন, যাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় ওয়ার্কশপগুলো গড়ে উঠেছে, তাঁদের বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে?

উচ্ছেদের ছবি দেখে মনে পড়ে-ভেজাল খাদ্যে ভরে থাকা বড় বড় ফুড চেইনের বিরুদ্ধে যখন মামলা হয়, তখন জরিমানা হয় পাঁচ হাজার, দশ হাজার টাকা। অথচ রিকশাচালকের ঘর ভেঙে দেওয়া হয়, চার্জিং স্টেশন তুলে দেওয়া হয়, এমনকি রিকশা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় স্রেফ "অবৈধ" তকমায়। রাষ্ট্রের শাসনযন্ত্র কি কেবল দুর্বলদের উপরই কার্যকর।

বাস্তবতা হলো-এই খাতটি উন্নয়নের অন্তরায় নয়, বরং হতে পারত আমাদের নগর ব্যবস্থাপনার একটি উদ্ভাবনী সংযোজন। সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আওতায় 

এনে লাইসেন্সিং, রেজিস্ট্রেশন, নির্ধারিত চার্জিং স্টেশন, মানসম্পন্ন ব্যাটারির ব্যবহার ও চালকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এ ব্যবস্থাকে করা যেত নিরাপদ ও টেকসই। এতে যেমন যানবাহনের নিরাপত্তা নিশ্চিত হতো, তেমনি শ্রমজীবী মানুষও পেত স্থায়ী কর্মসংস্থান।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, রাষ্ট্র এখনো কোনো বিকল্প কর্মসংস্থানের রূপরেখা প্রকাশ করেনি। আজ যাঁরা রিকশা চালিয়ে সংসার চালান, তাঁদের পুনর্বাসনের কথা কেউ ভাবেনি। অথচ জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রথম শর্তই হলো-নীতি গ্রহণের আগে মানুষের জীবনের প্রতি সংবেদনশীলতা।

আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিতে যখন পরিবেশবান্ধব যানবাহনের গুরুত্ব বাড়ছে, তখন ব্যাটারিচালিত রিকশা হতে পারত আমাদের নিজস্ব উদ্ভাবনের প্রতীক কিন্তু আমরা তা রূপান্তর না করে ধ্বংসের পথেই হেঁটেছি। এটি কেবল প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং আমাদের উন্নয়নদর্শণের আত্মঘাতী প্রকাশ। এই সময়ে-যখন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, কর্মস্থানের   সংকট এবং সামাজিক।

বৈষম্য গভীরতর হচ্ছে-তখন একটি বিদ্যমান ও জনগুরুত্বপূর্ণ খাতকে ধ্বংস করার আগে আমাদের ভাবতে হবে: আমরা কোন পথে চলছি? রাষ্ট্র কি কেবল উন্নয়নের বাহ্যিক মাপকাঠিতে নিজের সফলতা মাপে, নাকি মানুষের মুখের হাসিও সেখানে মূল্য পায়?

শেষত, মনে রাখতে হবেড়রিকশার এই নীরব চাকা শুধু একটি বাহন নয়, এটি নিম্নআয়ের মানুষের একফালি স্বপ্ন, জীবনের ভরসা। এই চাকার কান্না যেন রাষ্ট্রের নিঃসঙ্গ নীতিনির্ধারকদের মন না ছুঁয়েও না যায়।

Link copied!