বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১২:২৬ অপরাহ্ন

আপডেট
একাত্তরের ভুল প্রমাণিত হলে জাতির কাছে ক্ষমা চাইব: জামায়াত আমির রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের বিধান থাকছে না সংসদ ও স্থানীয় নির্বাচনে একবারে ভোটগ্রহণের প্রস্তাব সাবেক সিইসি রউফের দুর্যোগে সশস্ত্র বাহিনী দুর্গত জনগণের শেষ ভরসার স্থান জাতি গঠনমূলক কাজে সশস্ত্র বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে শিখা অনির্বাণে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার শ্রদ্ধা ঢাকার সড়কে অটোরিকশা চালকরা, বন্ধ যান চলাচল জেনারেল ওয়াকারের সঠিক সিদ্ধান্তে সশস্ত্র বাহিনী আবারও আস্থার প্রতীক ময়মনসিংহে ট্যুরিস্ট পুলিশের “National Integrity Strategies” বিষয়ক কোর্স এর সমাপনী অনুষ্ঠানে রেঞ্জ ডিআইজি বিভাগের শিক্ষার্থীদের ১১ দফা: জাবি ক্যাম্পাসে মোটরচালিত যানবাহন বন্ধ
সাগরপথে ইয়াবা, অন্ধকারে রাঘববোয়ালরা

সাগরপথে ইয়াবা, অন্ধকারে রাঘববোয়ালরা

সাগরপথে ইয়াবা, অন্ধকারে রাঘববোয়ালরা

মোঃ আবু তাহের, কক্সবাজার থেকে ফিরে : দেশে ইয়াবা প্রবেশের সূতিকাগার হলো কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্ত। র‌্যাব, পুলিশ, বিজিবি ও কোস্টগার্ডের নজরদারিকে ফাঁকি দিয়ে প্রবেশ করা এসব ইয়াবা ছড়িয়ে যাচ্ছে সারাদেশে। সীমান্ত পার হয়ে কক্সবাজারে প্রবেশের পর বাস ও পণ্যবাহী ট্রাকে করে ঢাকাসহ সারাদেশে ছড়িয়ে যায়। শুধু বাস নয়, এর পাশাপাশি বিমানে করে ঢাকায় প্রবেশ করে এসব ইয়াবা। কক্সবাজার বিমানবন্দর কিংবা চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে বিমানে করে পাচারকারীরা ইয়াবা এনে থাকে।

ইয়াবার ভয়ঙ্কর ছোবল থেকে দেশকে রক্ষা করতে র‌্যাব ২০১৮ সালের ৩০ এপ্রিল এক সংবাদ সম্মেলন করে ইয়াবার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে । এরপর থেকে সারা দেশে র‌্যাব ও পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ইয়াবা সিন্ডিকেটের রাঘববোয়ালরা নিহত হতে থাকে। তবে ২০২০ সালের ৩১ জুলাই টেকনাফে পুলিশের হাতে মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ নিহত হওয়ার পর বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা একেবারে কমে আসে। এরপরই গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নতুন করে ইয়াবা কারবারি ও বিক্রেতার তালিকা করতে মাঠে নামে।

সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার করা ইয়াবা পাচারকারিদের নতুন খসড়া তালিকায় পৌরসভার কাউন্সিলর, সাংবাদিক, অবসরপ্রাপ্ত বিজিবি সদস্য, রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দও রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর করা এই তালিকায় এক নম্বরে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কক্সবাজারের দক্ষিণ রুমালিয়াছিড়ার শাহানবাড়ির মো. নুরু। জানা গেছে, নুরুর একাধিক ট্রলার আছে। ট্রলারের নিচে প্লাস্টিক বা পলিথিন দিয়ে ইয়াবা পেঁচিয়ে বেঁধে পাচার করা হয়। তালিকার দুই নম্বরে স্থান পেয়েছে কক্সবাজার সদর থানা রোডের মোহাম্মদ আলী। এক সময় দরিদ্র মোহাম্মদ আলী এখন কোটিপতি। তবে, তার বিরুদ্ধে থানায় কোনো মামলা নেই।

তালিকার তিন নম্বরে আছেন, দক্ষিণ রুমালিয়ার বাসিন্দা মিজান। এক সময় কক্সবাজার জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মিজানের একাধিক ট্রলার রয়েছে, এই ট্রারের মাধ্যমে মিয়ানমার থেকে তিনি সাগরপথে ইয়াবা আনেন। ইয়াবা কারবারিদের তালিকার এক নম্বরে থাকা মো. নুরু তার আপন ভাই।

তালিকায় আরো যাদের নাম রয়েছে তারা হলেন, উত্তর রুমালিয়ারছড়া এলাকার বাসিন্দা এনামুল হক এনাম ওরফে বৈদ্য এনাম, সুলতান আহমেদ ওরফে রোহিঙ্গা সুলতান, টেকপাড়ার সংবাদকর্মী ইমরুল কায়েস চৌধুরী, কক্সবাজার পৌরসভার ১ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আক্তার কামাল, ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মিজানুর রহমান, ৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সাহাব উদ্দিন সিকদার, ৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর জামসেদ আলী, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার আশুগঞ্জের মোশারফ আলম ওরফে কানা মোশারফ, চকরিয়ার শিকলঘাট এলাকার রেজাউল করিম সেলিম, চকরিয়ার কোনাখালীর দিদারুল হক শিকদার, চকরিয়ার জিয়াবুল হক কমিশনার, চকরিয়ার রেজাউল করিম, কক্সবাজারের ছনখোলা গ্রামের আইয়ুব, কক্সবাজার সদর থানার লাহারপাড়ার আবুল কালাম ও আবু সৈয়দ, কক্সবাজারের বাংলাবাজারের আবছার, খুরুশকূল তেতৈয়া এলাকার জিয়াউর রহমান, চকরিয়ার সবুজবাগ এলাকার আজিজুল ইসলাম সোহেল, কক্সবাজারের মহেশখালীর জসীম উদ্দিন নাহিদ, মহেশখালীর ডেইলপাড়ার উসমান গনি, মহেশখালী পৌরসভার গোরকঘাটা এলাকার সালাহ উদ্দিন, আলহাজ মকসুদ মিয়া ও মাহবুব ওরফে গিইট্টে মাবু, কুতুবদিয়ার সিকদারপাড়ার হারুনুর রশিদ, টেকনাফের গেদারবিল এলাকার আবু সৈয়দ, আবু সৈয়দ মেম্বার, কেফায়েত উল্লাহ, টেকনাফের উত্তর লেঙ্গুর বিল এলাকার জাফর আহমদ, টেকনাফের ডেইল পাড়ার সাদ্দাম হোসেন, টেকনাফের সিকদার পাড়ার মো. রাসেল, টেকনাফের উত্তর লম্বরী গ্রামের আব্দুল কাদের, টেকনাফের ডেইল পাড়ার শফিক, টেকনাফের গোদারবিল এলাকার আবু কাশেম, জাহাঙ্গীর আলম ও মনির উল্লাহ, কুলালপাড়ার হায়দার আলী, দেলোয়ার হোসেন টিটু, জালাল ও সোহেল, টেকনাফের আলিয়াবাদ এলাকার নুর হোসেন, নুরুল আলম ওরফে ছোট ও আব্দুর রহিম, কেকে পাড়ার রফিক, ধোপারবিল এলাকার শহীদুল ইসলাম, পুরান পল্লান পাড়ার শাহ আলম, মধ্যম জালিয়া পাড়ার আব্দুল্লাহ, আব্দুল জব্বার, গুরাপুতু, আব্দুল গফুর ও ওসমান, উত্তর জালিয়া পাড়ার নূর মোহাম্মদ লাস্টিপ ও সালমান, দক্ষিণ জালিয়া পাড়ার রেজাউর রহমান রেজা, বড় হাবির পাড়ার আব্দুর রশিদ, ডেইলপাড়ার আব্দুল গফুর, আলীর ডেইল পাড়ার সৈয়দ আহমদ, মিঠাপানির ছড়া এলাকার সামসুল আলম, হাতিয়ার ঘোনা এলাকার দালাল হামিদুর রহমান, পূর্ব গেদার বিল এলাকার মৌলভী মো. রফিক, বাহারছড়ার শামলাপুরের শহিদ উল্লাহ, লেঙ্গুর বিলের শাহজাহান, শামলাপুরের পুরান পাড়ার মৌলভি আজিজ, সাবরাংয়ের মৌলভীপাড়ার আবদুর রহমান ও একরাম, রামু থানাধীন গুইন্যা পাড়ার রমজান, পূর্ব রাজঘাটের জাহানারা বেগম, ঈদগড়ের আব্দুর রহিম, মাঝিরকাটা গ্রামের কলিমুল্লাহ, গর্জনিয়া পাড়ার সিরাজুল হক, রেজাউল করিম, কাজরবিল গ্রামের নুরুল আফসার, কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের ফকিরকাটা পাড়ার আব্দুর রহমান, কক্সবাজারের উখিয়ার মমতাজ বেগম, রামু থানাধীন কাউয়ার ক্ষোপ এলাকার আব্দুর রাজ্জাক, ফরিদুল ইসলাম, ওবাইদুল হক জনি, পশ্চিম মনিরঝিল দরগাপাড়ার জাহাঙ্গীর আলম, লট উখিয়ার ঘোনা গ্রামের মো. শফি, চরপাড়ার ইকবাল হোসেন মামুন, ফতেখারুল গ্রামের জসিম উদ্দিন, রাখাল চন্দ্র দে, সৈয়দ শাহীন ওরফে আনসার শাহীন, শ্রীধনগাড়া গ্রামের নিককন বড়ুয়া, মণ্ডলপাড়ার সিরাজ, উখিয়া থানাধীন কড়ই বুনিয়া গ্রামের ইকবাল, নুরুল আমিন ভূঁইয়া ও নলবনিয়া গ্রামের আলী আহমদের নাম ইয়াবা ব্যবসায়ীর তালিকায় রয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, আশুগঞ্জের মোশারফ আলম ওরফে কানা মোশারফ ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার সীমান্ত দিয়ে ইয়াবা পাচারের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। পরে এসব কারণে তাকে এলাকা ছাড়তে হয়। এলাকা ছেড়ে সে বর্তমানে ঢাকার খিলগাঁওয়ে বসবাস শুরু করে। এলাকা ছাড়লেও সে তার ইয়াবার কারবার বন্ধ করেনি বরং তার ইয়াবা কারবারের বিস্তৃতি আরো ছড়াতে থাকে। তালিকার এক নম্বরে থাকা কক্সবাজারের নুরুর সাথে রয়েছে তার সুসম্পর্ক। জানা যায়, ঢাকায় আসলে নুরু মোশারফের বাসায় থাকে। তবে তাদের দুজনের মধ্যকার যোগাযোগ খুবই গোপনীভাবে হয় বলে জানা গেছে। যোগাযোগের ক্ষেত্রে তারা ভিন্ন সিম কার্ড ব্যবহার করে। মোশারফের নেতৃত্বে তার লোকজন ঢাকার ৩০-৪০ টি স্পটে ইয়াবা সরবরাহ করে থাকে। তবে ইয়াবার সাথে কানা মোশারফের সম্পৃক্ততা শুরু হয় মাদক মামলার আসামীদের জামিন করানোর মাধ্যমে। ইয়াবা কিংবা মাদক মামলায যেসব মাদক ব্যবসায়ী গ্রেফতার হয়, মোশারফ তাদের জামিন করানোর দায়িত্ব নেয়। মাদক মামলার আসামীদের জামিন করানোর সুবাদে মোশারফও ইয়াবা ব্যবসার সাথে জড়িয়ে পড়ে। তবে, তার বিরুদ্ধে থানায় কোনো মামলা নেই।

গত ২৩ জুলাই র‌্যাব-৩ রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকায় ইয়াবা বিক্রির সময় এ সময় তার কাছ থেকে ৭৬৫ পিস ইয়াবা, ১০টি মোবাইল ফোন, দুটি সিম কার্ড, একটি চাকু, একটি মাদক সেবনের পাত্র ও নগদ দুই হাজার ১৬০ টাকাসহ মো. আরিফ ওরফে বাবু নামে একজনকে গ্রেফতার করে। বাবু সীমান্তবর্তী জেলা কক্সবাজার থেকে ইয়াবা সংগ্রহ করে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করতো বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে। আটক বাবুর বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে।

এছাড়াও র‌্যাব সদস্যরা গত ১৪ মার্চ রাজধানীর হাজারীবাগ এলাকা থেকে এক লাখ ২৩ হাজার ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করে মো. আলম নামে একজনকে। এর পর জানা যায়, এই আলমের অপর নাম হোসেন আলী। বাড়ী কক্সবাজার জেলার উখিয়ার মহাশফির বিল গ্রামে। এলাকায় ইয়াবার ডিলার হিসেবে পরিচিত। আলম পরিচয়ে কক্সবাজারের কলাতলীতে শামীম হোসেন নামের এক ব্যক্তির ‘শামীম গেস্ট হাউস’ ভাড়া নেন তিনি। পরিচয় দিতেন মাছের পোনা ও জমি কেনাবেচার ব্যবসায়ী হিসেবে। সম্রাট আলম ওরফে হোসেন আলীর সঙ্গে তাঁর ছোট ভাই জসিম উদ্দিন আরমানকেও গ্রেপ্তার করা হয়।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) গোয়েন্দাদের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে এরকম আরো অনেক ইয়াবা ডিলারের পরিচয়। কক্সবাজারের এসকল ছদ্মবেশী ব্যবসায়ীরা ঢাকায় এসে ইয়াবার বড় ডিলার হয়ে ওঠেন। গত মার্চ মাসেই অভিযানে এমন আরো দুটি সিন্ডিকেট ধরা পড়েছে। ডিএনসির গোয়েন্দারা বলছেন, কক্সবাজারের এসব ছদ্মবেশী ব্যবসায়ীরা ঢাকায় আকাশপথে উড়োজাহাজে করে ইয়াবা নিয়ে আসে। ব্যক্তিগত গাড়ি ও বাসেও কিছু চালান আসে। এসব চালান ঢাকার হোটেলে বসেই বেশির ভাগ হাতবদল হয়। আর কিছু চালান অল্প সময়ের জন্য ভাড়া করা ফ্ল্যাটে বসে লেনদেন হয়।

অন্যদিকে অনুসন্ধানে জামিনে বের হওয়া কক্সবাজারের টেকনাফের অনেক ইয়াবা ব্যবসায়ীর সাথে কথা বলে জানা যায়, কানা মোশারফসহ ঢাকায় ছদ্মবেশে থাকা অনেক ইয়াবা ডিলার তাদের শেল্টার দিয়ে থাকে। তারা জানায়, যারা মাদক পাচার কিংবা দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করতে গিয়ে গ্রেফতার হয়, কানা মোশারফ তাদের জামিন করিয়ে দেয়।

প্রসঙ্গত, আশির দশকের শেষদিকে দেশে ইয়াবার কারবার শুরু হয়। কিন্তু দেশের মানুষ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামনে ইয়াবা ব্যবসার বিষয়টি আসে ২০০৫ সালের শেষের দিকে। ১৯৯৪ সাল থেকে ইয়াবার চালান মিয়ানমার সীমান্ত হয়ে ঢাকা আসতে শুরু করে। তখন ইয়াবা সম্পর্কে সাধারণ মানুষ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তেমন কিছু জানত না। সে সময় ভারতীয় ফেনসিডিল, পেথেডিন ইনজেকশন, হেরোইন ও গাঁজা পাওয়া যেত। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বর্তমানে শুধু কক্সবাজারেই দুই হাজারের বেশি ব্যক্তি ইয়াবা কারবারের সঙ্গে জড়িত। এ কারবারিদের ৭০ শতাংশ টেকনাফ ও উখিয়ার এবং ৩০ শতাংশ কক্সবাজার সদরের। তাদের মধ্যে কেউ গডফাদার, কেউ পাচারকারী, কেউ আশ্রয়দাতা, কেউ সেবনকারী ও ব্যবসায়ী।

শেয়ার করুন

Comments are closed.




দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ © All rights reserved © 2024 Protidiner Kagoj |