বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:১৮ অপরাহ্ন
অনলাইন ডেস্ক: চট্টগ্রামে মামলার হুমকি দিয়ে শামশুউদ্দিন বাহাদুর (৫৮) নামে এক ব্যক্তির কাছে থেকে ৭০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপ-সহকারী পরিচালক মিজানুর রহমান চৌধুরীর বিরুদ্ধে। সম্প্রতি এ সংক্রান্ত একটি মামলা হয়েছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে। যেখানে এ দুদক কর্মকর্তা ছাড়াও তার সহযোগীদের আসামি করা হয়েছে।
ভুক্তভোগী ও মামলা সূত্রে জানা যায়, ছয় জনের কাছে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের এলাকার ৩১ শতক জমি বিক্রি করেন চট্টগ্রামের বাঁশখালীর বাসিন্দা শামশুউদ্দিন বাহাদুর (৫৮)। কাগজে-কলমে প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকায় এই জমি বিক্রি করা হয়। বিক্রির দুই মাস পর জমির দলিলে বিক্রিকৃত মূল্যের চেয়ে টাকা কম উল্লেখ আছে দাবি করে বাহাদুরকে দেখা করতে বলেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপ-সহকারী পরিচালক মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি টিম।
বাহাদুরকে মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দিয়ে তিনটি প্রতিষ্ঠানের নামে ৭০ লাখ টাকার পে-অর্ডার আদায়ের অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া, আদায় করেন আরও পাঁচটি খালি চেক। যেগুলোর মাধ্যমে পরবর্তীতে ৪০ লাখ টাকা বাহাদুরের ব্যাংক থেকে উত্তোলনের চেষ্টা করা হয়। যদি চেকগুলো দিয়ে পরবর্তীতে টাকা উত্তোলন করা সম্ভব হয়নি।
এ ঘটনার পর থেকে একেবারে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন ভুক্তভোগী বৃদ্ধ বাহাদুর। তিনি ঘটনায় জড়িত দুদক কর্মকর্তার শাস্তি দাবি করেন। যদিও অভিযুক্ত দুদক কর্মকর্তা মিজানুর ভুক্তভোগী বাহাদুরের কাছ থেকে টাকা আদায়ের বিষয়টি অস্বীকার করেন। তবে তিনি জানান, জমি বিক্রির পর দলিলে কম মূল্য দেখানোর কারণে একজন লোকের মাধ্যমে বাহাদুর তার অফিসে গিয়েছিলেন। তখন তিনি বাহাদুরকে কম মূল্য দেখানোর কারণে সরকার যে রাজস্ব বঞ্চিত হয়েছে সেটি যথোপযুক্ত পন্থায় পরিশোধের পরামর্শ দেন। অন্যথায় বাহাদুর যেকোনো সময় আইনি জটিলতায় পড়তে পারেন বলে সতর্ক করেন।
চাঞ্চল্যকর ঘটনাটি নিয়ে গত ৬ নভেম্বর চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন ভুক্তভোগী বাহাদুর। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।
আসামিরা হলেন- চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার বাসিন্দা তমিজ উদ্দীন, মো. মিজানুর রহমান চৌধুরী, মোহাম্মদ হাসান, কুসুম আক্তার, মোহাম্মদ আকতার, রাজিব ঘোষ ও নিপু বড়ুয়া। তাদের মধ্যে মিজানুর রহমান দুর্নীতি দমন কমিশনের উপ-সহকারী পরিচালক। দীর্ঘদিন চট্টগ্রামে চাকরি করে সম্প্রতি তিনি কুড়িগ্রাম জেলায় বদলি হয়েছেন। তার পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় এ ঘটনা ঘটেছে বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়।
আসামিদের তালিকায় দুদক কর্মকর্তা মিজানুর রহমানের বিস্তারিত পরিচয় উল্লেখ না করার কারণ হিসেবে জানা যায়, এর আগে মিজানুরের পরিচয় দিয়ে যতবার মামলা করা হয়েছিল ততবারই মামলা আর গ্রহণ করতেন না আদালত। এ কারণে সবশেষ মিজানুরের পেশাগত পরিচয় আর উল্লেখ করা হয়নি।
মামলার এজাহার ও ঘটনার বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০০৭ সালের ৭ জুন ভুক্তভোগী বাহাদুর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ এলাকার বাড়িয়ছনী মৌজার ৩১ শতক জমি ক্রয় করেন। সম্প্রতি টাকার প্রয়োজন হলে জমিটি বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন বাহাদুর। এজন্য মামলার প্রধান আসামি ও তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু তমিজ উদ্দিনের সঙ্গে আলাপ করেন তিনি। তমিজ জমিটি চার কোটি ৫৫ লাখ টাকা দিয়ে বিক্রি করে দেওয়ার আশ্বাস দেন বাহাদুরকে। এরপর জমি বিক্রির জন্য গত ১০ জুন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা আসেন বাহাদুর। ১১ জুন ৬ জনের নামে জমিটি বিক্রি করে দেন বাহাদুর। ক্রেতারা এ বাবদ চার কোটি ৫৫ লাখ টাকার পে-অর্ডার দেন বাহাদুরকে।
এরপর ১৪ আগস্ট ঘটে আরেক কাণ্ড। মামলার আসামি হওয়া তমিজ ও দুদক কর্মকর্তা মিজানুর রহমান হোয়াটসঅ্যাপে কল দিয়ে বাহাদুরকে মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দেন। কারণ হিসেবে বলেন, সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জে যে জমিটি বিক্রি করা হয়েছে সেটির মূল্য কম দেখানো হয়েছে। এ কারণে সরকার রাজস্ব কম পেয়েছে। এটি দুদক আইনে অপরাধ।
এর পরদিন বাহাদুরের সঙ্গে দেখা করেন তমিজ ও মিজান। এ সময় মিজানের সহযোগীও একজন ছিলেন। তখন বাহাদুরকে হুমকি দেওয়া হয়, নারায়ণগঞ্জে যে জমিটি বিক্রি করা হয়েছে সেটির দলিলে মূল্য কম দেখানো আছে। এজন্য মামলা করবে দুদক এবং গ্রেপ্তার হতে হবে বাহাদুরকে। তবে এই শাস্তি থেকে বাঁচা যাবে, যদি দুদক কর্মকর্তা মিজানুর এবং তমিজকে দুই কোটি ২০ লাখ টাকা দেওয়া হয়। কিন্তু টাকা দিতে অপারগতা জানান বাহাদুর। একপর্যায়ে নানা কৌশলে বাহাদুরকে হত্যার হুমকিও দেন অভিযুক্তরা।
এ ঘটনার পর ১৫ আগস্ট তমিজের সহযোগিতা নিয়ে দুদক কর্মকর্তা মিজানুরেরর সঙ্গে দেখা করেন বাহাদুর। তখন মিজানুরের সঙ্গে দুদকের আরও কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন। এ সময় তারা পুনরায় বাহাদুরের কাছ থেকে দুই কোটি ২০ লাখ টাকা দাবি করেন। এসব টাকা যদি না দেওয়া হয় বাহাদুরের জমি বিক্রির টাকা যে ব্যাংকে রাখা হয়, সেটির অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করে দেবেন বলে হুমকি দেন মিজানুর। একপর্যায়ে মিজানুর প্রথমে বাহাদুরকে তিনটি প্রতিষ্ঠানের নামে ৭০ লাখ টাকা পে-অর্ডার দিতে বলেন। তখন বাহাদুর জানান, যেহেতু জমি বিক্রির দলিল এনসিসি ব্যাংক চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা শাখায় জমা দেওয়া হয়নি সে কারণে তিনি পে-অর্ডার করতে পারবেন না। তখন তমিজ কোমরে গুঁজে রাখা একটি ছুরি বের করে বাহাদুরকে হত্যার হুমকি দেন এবং মিজানুর মামলার মাধ্যমে যাবজ্জীবন সাজা খাটানোর হুমকি দেন। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন বাহাদুর। একপর্যায়ে তিনি টাকা দিতে রাজি হন।
১৮ আগস্ট মিজানুর ও তমিজের দাবি করা টাকা পরিশোধ করার জন্য পে-অর্ডার করতে ঢাকায় যান বাহাদুর। কারণ, ডাচ বাংলা ব্যাংক লিমিটেড মতিঝিল শাখায় তার একটি অ্যাকাউন্ট রয়েছে। ওই অ্যাকাউন্ট থেকে তমিজ ও দুদক কর্মকর্তা মিজানুরের কথা মোতাবেক বাহাদুর তিনটি প্রতিষ্ঠানের নামে তিনটি পে-অর্ডার করেন। এর মধ্যে মেসার্স বেস্ট ফুড ট্রেডার্সের নামে ৩০ লাখ, মেসার্স নিজাম এন্টারপ্রাইজের নামে ২৫ লাখ এবং তালুকদার এন্টারপ্রাইজের নামে ১৫ লাখ টাকার পে-অর্ডার করা হয়। ১৯ আগস্ট চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ এলাকার সেন্টমার্টিন হোটেলে এসে দুদক কর্মকর্তা মিজানুরের প্রতিনিধির হাতে পে-অর্ডার তিনটি তুলে দেন বাহাদুর। ওই সময় মিজানুরের প্রতিনিধি বাহাদুরের নামে যেসব মামলা দুদকে ফাইল করা হয়েছে, সেগুলো ছিঁড়ে ফেলার অভিনয় করেন। একই সঙ্গে দ্রুত বাহাদুরকে আরও ৪০ লাখ টাকা পরিশোধের জন্য চাপ দেওয়া হয়।
২৬ আগস্ট বাহাদুরকে ডাকেন তমিজ এবং জরুরি মিজানুরের সঙ্গে দেখা করতে হবে বলেন। সঙ্গে বাহাদুরকে এনসিসি ব্যাংকের চেক বই আনতে বলেন তমিজ। বাহাদুরকে নিয়ে চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজ এলাকায় যান তমিজ। দুদক কর্মকর্তা মিজানুর সহযোগীদের নিয়ে আগে থেকে সেখানে উপস্থিত ছিলেন। মিজানুরসহ আসামিরা বাহাদুরের কাছ থেকে এনসিসি ব্যাংক আন্দরকিল্লা শাখার পাঁচটি খালি চেকে সই করিয়ে নেন। যেগুলোতে পরবর্তীতে ৪০ লাখ টাকার অঙ্ক বসানো হয়। এরপর থেকে বাহাদুরকে এসব চেক পাশ করার জন্য ব্যাংককে অনুমতি দিতে চাপ দিতে থাকেন তমিজ আর মিজানুররা। সবশেষ আসামিদের চাপে কোনো উপায় না পেয়ে চট্টগ্রাম আদালতে মামলা করেন ভুক্তভোগী বাহাদুর।
এ বিষয়ে মামলার বাদি শামশুউদ্দিন বাহাদুর ঢাকা পোস্টকে বলেন, মামলার প্রধান আসামি তমিজ আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তার সঙ্গে আবার দুদক কর্মকর্তা মিজানুরের সম্পর্ক রয়েছে। অসৎ উদ্দেশ্যে তমিজ তার সহযোগী দুদক কর্মকর্তা মিজানুরকে নিয়ে আমার কাছ থেকে জায়গা বিক্রির পর পে-অর্ডার মূলে ৭০ লাখ এবং ৪০ লাখ টাকার চেক নেন। যদিও চেকগুলো তিনি ক্যাশ করাতে পারেননি। তবে পে-অর্ডারের ৭০ লাখ টাকা উত্তোলন করেন তারা। এ ঘটনার পর থেকে আমি মানসিকভাবে একেবারে ভেঙে পড়েছি। একবার স্ট্রোকও করেছিলাম। এখন আমি অভিযুক্ত দুদক কর্মকর্তা মিজানুর ও তার সহযোগীদের শাস্তি চাই এবং আমার টাকা ফেরত চাই।
মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট এস এম দিদার উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি আইনের ৪০৬, ৪২০, ৩৮৬, ৫০৬ (২) ও ৩৪ ধারায় অপরাধ আনা হয়েছে। আসামিরা পে-অর্ডারমূলে যে টাকা আদায় করেছে এবং খালি চেক নিয়ে গেছে এগুলোর প্রমাণ দেওয়া হয়েছে। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে সিআইডিকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।
সার্বিক অভিযোগের বিষয়ে দুদক চট্টগ্রামের সাবেক উপ-সহকারী পরিচালক ও বর্তমান কুড়িগ্রাম জেলা কার্যালয়ে একই পদে কর্মরত মো. মিজানুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, তমিজ উদ্দীন নামে আমি কাউকে চিনি না। তবে যার কাছ থেকে টাকা আদায় করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে সেই বাহাদুরকে আমি চিনি। তিনি একবার আমার অফিসে এসেছিলেন আমার পরিচিত এক লোককে ধরে। তখন তিনি জায়গা বিক্রির সময় দলিলে কম মূল্য দেখানোর বিষয়টি স্বীকার করেন। তখন আমি তাকে সতর্ক করি এটা স্পষ্ট অপরাধ। কারণ, এক্ষেত্রে সরকার যথাযথ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আমি তাকে বলেছি কম মূল্য দেখানোর কারণে সরকার যে পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে সেটি যেন তিনি পরিশোধ করে দেন। না হয় তিনি যেকোনো সময় আইনি জটিলতায় পড়তে পারেন। টাকা আদায় তো দূরে থাক এরপর থেকে বাহাদুরের সঙ্গে আমার আর কথা হয়নি। এখন কেন তিনি আমার বিষয়ে অভিযোগ তুললেন এবং মামলা করলেন বিষয়টি আমি বুঝতে পারছি না।