বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১২:২৬ অপরাহ্ন
রেজাউল করিম রেজা,ময়মনসিংহ : ময়মনসিংহে পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে অবস্থিত ময়মনসিংহ জেলা একটা সময় পরিচিত ছিল এই প্রবাদে। ময়মনসিংহের বিভিন্ন উপজেলায় রয়েছে অসংখ্য বিল, জলাশয় ও প্লাবনভূমি। সরকারি হিসাবে জেলার ১৩টি উপজেলায় বিল ও প্রধান প্লাবনভূমির সংখ্যা ১১৪০টি। বরিল, বাইশা, কাজলকৌটা, রোয়া, নিমুরিয়া ধনড়া বিলসহ অসংখ্য বিলের কারণে পরিচিত ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলা। কিন্তু উপজেলার মানকোন ইউনিয়নে অবস্থিত ধনড়া বিল ভরাট করে নির্মিত হচ্ছে সোলার পার্ক।
গ্রামবাসীর প্রতিবাদের মধ্যেই সম্প্রতি শুরু হয়েছে ২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার সোলার পার্কের নির্মাণ কাজ চলমান। বিলের ৭০ একর জমির ওপর স্থাপিত হচ্ছে এই সোলার পার্ক। বিলের জলাশয় ভরাট করে সোলার পার্ক স্থাপনের বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরেই গ্রামবাসীর সঙ্গে দেনদরবার চলছিল। সাবেক প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদের দোসরদের মধ্যস্থতায় আবাদি জমিতেই শুরু হয়েছে সোলার পার্কের কাজ।
ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল মহাসড়কের পাশে নিমুরিয়া গ্রামে বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে উঠেছে ধনুড়া বিল। বিলের দুই পাশের দুটি গ্রামের বাসিন্দাদের প্রায় শতাধিক একর জমি রয়েছে এই বিলে। বছরে একবারই ধান আবাদ হতো। স্থানীয়রা জানান, প্রতি বছর কয়েক শত মেট্রিক টন বোরো ধান উৎপাদন হতো ধনিয়া বিলে। বিলের পাশে তিন শতাধিক কৃষকের জমি রয়েছে। তারা বিলে ধান আবাদের মাধ্যমে নিজেদের বার্ষিক খোরাকের বড় অংশ মেটাতেন। পাশাপাশি বিলে মাছ ধরেও অসংখ্য মানুষ জীবিকা নির্বাহ করত। বিলের ভেতরে রয়েছে কয়েকটি মৎস্য খামারও। এখন সেই বিল ভরাট করে স্থাপিত হচ্ছে সোলার পার্ক।
জুস পাওয়ার লিমিটেড কোম্পানির মালিকানাধীন সোলার পার্কটি স্থাপনে স্থানীয় ২৫০ কৃষকের কাছ থেকে ৭০ একর জমি ২২ বছর মেয়াদে ভাড়া নেওয়া হয়েছে। এটি স্থাপনে দীর্ঘদিন ধরে গ্রামবাসীর সঙ্গে দেনদরবার চলে। বিলের চারপাশের অনেক কৃষক নিজেদের আবাদি জমি দিতে চাননি এ কাজে কিন্তু সাবেক প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ প্রভাব বিস্তার করে জোরপূর্বক দখল করে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। জমি সোলার পার্কে দিলে তাদের ধান আবাদের মতো কোনো জমি থাকবে না। কিন্তু গ্রামের কয়েকজন আ,লীগ বর্তমানে বিএনপির কয়েক প্রভাবশালীর কারণে তারা বাধ্য হয়েছেন জমি দিতে। কৃষকদের বাধার মধ্যেই গত ৩১ মে স্থানীয় সাবেক সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম ২০ মেগাওয়াট সোলার পার্কটির কাজ উদ্বোধন করেন।
নিমুরিয়া গ্রামের বাসিন্দা আহসান হাবিব জানান, তিনি ২০ শতাংশ জমি দিয়েছেন সোলার পার্ক কর্তৃপক্ষের কাছে। এতে তাকে বছরে ১১ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। প্রথমে বিলের জমি দিতে রাজি না হলেও পরে অন্যদের দেখাদেখি জমি ভাড়া দিতে বাধ্য হন। তিনি বলেন, এই বিলে এক সময় দুই ফসলি ধান আবাদ হতো। বিলের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকায় বর্তমানে বছরের একটা সময় জমি অনাবাদি থাকে। এখানে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হলে ধান আবাদের পরিমাণ দ্বিগুণ হতো।
একই গ্রামের বাসিন্দা আজিজুল ইসলাম বলেন, আমার জমিই প্রথম ভরাট করা হচ্ছে। এটি ছিল আবাদি ক্ষেত। সবাই দিচ্ছে বিধায় বাধ্য হয়েই দিতে হয়েছে। ১৯০ শতাংশ জমি ভাড়া নিয়েছে সোলার পার্ক। প্রতি বছর আমাদের প্রতি শতাংশে ২ হাজার ১০০ টাকা হারে ভাড়া দেবে। বিলের ভেতর আমার আরও কিছু জমি আছে। ওইগুলো দিইনি। সব জমি দিয়ে দিলে চাষ করার মতো কিছুই থাকবে না।
জুস পাওয়ার লিমিটেড কোম্পানির এই পাওয়ার পার্কের কো-অর্ডিনেটর মাহফুজুর রহমান মাছুম বলেন, এই বিলটি অনাবাদি ছিল। এখানে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় ফসল হতো না। এ কারণেই এই বিলের জমি কৃষকদের কাছ থেকে ২২ বছরের জন্য ভাড়া নেওয়া হয়েছে। কারও জমি জোর করে নেওয়া হয়নি। কৃষকরা স্বেচ্ছায় জমি দিয়েছেন। এবিষয়ে এলাকাবাসীর পক্ষে গত ১৭ নভেম্বর উপ-পরিচালক পরিবেশ অধিদপ্তর ময়মনসিংহ বরাবরে একটি লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছেন।
জানা গেছে, পরিবেশ অধিদপ্তর ময়মনসিংহের উপপরিচালক (ডিডি) নাজিয়া উদ্দিন তদন্তের নামে না আমি মাত্র পরিদর্শন করে সুবিধাভোগীদের কাছ থেকে মোট অংকের টাকা নিয়ে অভিযোগ ফাইল বন্দি করে রাখে।
প্রতিদিনের কাগজের পক্ষ থেকে জানতে চাইলে তিনি বলেন দুর্নীতি করার কোন সুযোগ নেই। অভিযোগ পেয়েছি তদন্ত চলছে। কবে শেষ হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি অফিসিয়াল বিষয় আপনাদের বলা যাবে না।
সোলার পার্ক স্থাপনে কৃষিজমি নষ্ট হচ্ছে স্বীকার করে মুক্তাগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সেলিনা পারভীন প্রতিদিনের কাগজকে বলেন, বিলে বছরে এক ফসল হিসেবে ধান আবাদ হতো। সোলার পার্ক স্থাপনে আবাদি জমি নষ্ট হচ্ছে এটা সত্যি। কিন্তু এলাকাবাসী এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ করেননি। কৃষকদের কাছ থেকে অভিযোগ পেলে বিষয়টি দেখব। এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহমুদা হাসানের সঙ্গে বেশ কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও কথা বলা যায়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে, সুপ্রীম কোর্টের ব্যারিস্টার আকরাম হায়দার চৌধুরী বলেন, কৃষি জমির ভরাট করে যারা এ ধরনের বাণিজ্যিক ব্যবসা করছেন তাদের জন্য রয়েছে ভয়াবহ দিন। প্রয়োজনে উচ্চ আদালতে নজরে আনা হবে।