শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ০৮:২৫ অপরাহ্ন

আপডেট
পিতা-মাতার ভরণ-পোষণে অস্বীকৃতিতে আইনি প্রতিকার

পিতা-মাতার ভরণ-পোষণে অস্বীকৃতিতে আইনি প্রতিকার

অনেক সন্তানরা বৃদ্ধ বয়সে তাদের পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ করতে চায় না, তাদেরকে বাড়ী থেকে বের করে দিতে চায়, বৃদ্ধাশ্রমে যেতে বাধ্য করা হয় এবং তাদের স্ত্রী বা নিকটাত্মীয় উক্তরূপ কাজে সহায়তা করে থাকে। অনেকক্ষেত্রেই পিতামাতাকে বৃদ্ধ বয়সে অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশার সম্মুখীন হতে হয়। তাই সন্তান কর্তৃক পিতামাতার ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করন প্রয়োজনীয় ও সমিচীন মনে হওয়ায় বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সনে পিতামাতার ভরণ-পোষণ আইন নামে একটি আইন পাশ করেন। উক্ত আইনটি ২৭ অক্টোবর ২০১৩ সনে আইন পাশ করা হয় এবং উহা ২০১৩ সনের ৪৯ নং আইন।

* উক্ত আইনের ২ ধারা অনুযায়ী পিতা বলতে কোন সন্তানের জনককে বুঝাবে।
* ভরণ পাষণ অর্থ খাওয়া-দাওয়া, বস্ত্র, চিকিংসা ও বসবাসের সুবিধা এবং সঙ্গ প্রদানকে বুঝায়।
* মাতা বলতে কোন সন্তানের গর্ভধারিনীকে বুঝাবে।
* সন্তান বলতে পিতার ঔরষে এবং মাতার গর্ভে জন্ম নেওয়া সক্ষম ও সামর্থবান পুত্র বা কন্যাকে বুঝাবে। পিতামাতার ভরণ ভরণ-পোষণ আইন, ২০১৩ অনুযায়ী সন্তান কর্তৃক পিতামাতার ভরণ-পোষণ প্রদানকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এবং কোন সন্তান যদি পিতামাতার ভরণ-পোষণ দিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে সেইক্ষেত্রে সন্তানের জন্য শাস্তির বিধান করা হয়েছে।

পিতামাতার ভরণ-পোষণ কে করবেন এবং কিভাবে করবেনঃ ২০১৩ সনের পিতামাতার ভরণ-পোষণ আইনের ৩ ধারার ১ উপধারায় বলা হয়েছে, প্রত্যেকে সন্তানকে তার পিতামাতার ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করতে হবে।
* ৩(২) ধারায় বলা হয়েছে কোন পিতামাতার একাধিক সন্তান থাকলে সেইক্ষেত্রে
সন্তানগণ নিজেদের মধ্য আলাপ-আলোচনা করিয়া তাদের পিতামাতার ভরণ-পোষণ নিশ্চিত
করিবে।
*৩(৩) ধারার অধীন পিতামার ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করিবার ক্ষেত্রে পিতামাতার সাথে একই সঙ্গে একই স্থানে বসবাস নিশ্চিত করতে হইবে।
* ৩(৪) ধারায় কোন সন্তান তাহার পিতা বা মাতাকে বা উভয়কে তাহার বা ক্ষেত্র মত তাহাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন বৃদ্ধ নিবাস কিংবা অন্য কোথাও একত্র কিংবা আলাদা আলাদাভাবে বসবাস করিতে বাধ্য করা যাবে না।
* ৩(৫) ধারা- প্রত্যেক সন্তান তার পিতা এবং মাতার স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজ খবর রাখিবে, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা ও পরিচর্যা করিবে।
* ৩(৬) ধারা- পিতা বা মাতা কিংবা উভয় সন্তান হইতে পৃথকভাবে বসবাস করিলে সেইক্ষেত্রে প্রত্যেক সন্তানকে নিয়মিতভাবে তাহার বা ক্ষেত্র মতে তাহাদের সহিত সাক্ষাত করিতে হইবে।
* ৩(৭) কোনো পিতা বা মাতা কিংবা উভয়ে সন্তানদের সাথে বসবাস না করিয়া পৃথকভাবে বসবাস করিলে সেইক্ষেত্রে উক্ত পিতা বা মাতার প্রত্যেক সন্তান তাহার দৈনন্দিন আয়- রোজগার বা ক্ষেত্র মত মাসিক আয় বা বাৎসরিক আয় হইতে যুক্তিসঙ্গত পরিমাণ অর্থ পিতা বা মাতা বা ক্ষেত্রমত উভয়কে নিয়মিত প্রদান করিবে।

পিতামাতার অবর্তমানে সন্তান/সন্তানগণ কাদের ভরণ-পোষণ প্রদান করবেঃ ৪। প্রত্যেক সন্তান তাহার
(ক) পিতার অবর্তমানে দাদা-দাদীকে এবং
(খ) মাতার অবর্তমানে নানা-নানীকে
ধারা-৩ এ বর্ণিত ভরণ-পোষণ প্রদানে বাধ্য থাকিবে এবং এই ভরণ-পোষণ পিতামাতার ভরণ-পোষণ হিসাবে গণ্য হইবে।

মামলা দায়ের সংক্রান্ত বিধানঃ পিতামাতা বা ক্ষেত্র মত দাদা-দাদী, নানা-নানী উক্ত আইনের ৫ ধারায় ১ম শ্রেণীর জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে অথবা মেট্রোপলিটন ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে মামলা দায়ের করতে পারবেন এবং বিজ্ঞ আদালত সরাসরি আসামীর বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে নিত পারবেন।

পিতামাতার ভরণ-পোষণ দিতে অস্বীকার করলে শাস্তিঃ ২০১৩ সনের পিতামাতার ভরণ-পোষণ আইনের ৫(১) ধারায় বলা হয়েছে কোন সন্তান কর্তৃক ধারা ৩ এর যেকোন উপধারার বিধান কিংবা ধারা ৪ এর বিধান লংঘন করলে উহা অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে এবং উক্ত অপরাধের জন্য ১ লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা ৩ মাস কারাদন্ডে দন্ডিত হবে।

পিতামাতা বা পিতামাতার অবর্তমানে দাদা-দাদী, নানা-নানীর ভরণ-পোষণ করতে না দিলে বা অসহযোগিতা করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি প্রতিকারঃ ৫(২) ধারায় বলা হয়েছে কোন সন্তানের স্ত্রী বা ক্ষেত্র মত স্বামী কিংবা পুত্র বা কন্যা বা অন্য কোন নিকটাত্বীয় ব্যক্তিঃ-
(ক) পিতামাতার বা দাদা-দাদী বা নানা-নানীর ভরণ-পোষণ প্রদানে বাঁধা প্রদান করিলে বা
(খ) পিতামাতার বা দাদা-দাদীর বা নানা-নানীর ভরণ-পোষণ প্রদানে অসহযোগীতা করিলে তিনি উক্তরূপ অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করিয়াছে বলে গণ্য হবে এবং উক্তরূপ সহযোগিতা করার জন্য উপধারা (১) এ উল্লেখিত দন্ডে দন্ডিত হবে।

অপরাধের আমলযোগ্যতা, জামিনযোগ্যতা ও আপোষ যোগ্যতাঃ ২০১৩ সনের পিতামাতার ভরণ-পোষণ আইনের ৬ ধারায় বলা হয়েছে এই আইনের অধীন আমলযোগ্য, জামিনযোগ্য ও আপোষযোগ্য হইবে।

অপরাধের বিচারঃ ২০১৩ সনের পিতামাতার ভরণ-পোষণ আইনের ৭(১) ধারায় বলা হয়েছে ঞযব পড়ফব ড়ভ পৎরসরহধষ ঢ়ৎড়পবফঁৎব ১৮৯৮ এ যাহা কিছুই থাকুক না কেন এই আইনের অধীন সংঘটিত অপরাধ ১ম শ্রেণীর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্টেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিষ্ট্রেটের আদালতে বিচারযোগ্য হইবে।

কে মামলা দায়ের করতে পারবেনঃ ২০১৩ সনের পিতামাতার ভরণ-পোষণ আইনের ৭(২) ধারার বিধান অনুযায়ী এই আইনের অধীন সংঘটিত অপরাধের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সন্তানের পিতা বা মাতার লিখিত অভিযোগ ব্যতিত কোন আদালত অপরাধ আমলে গ্রহণ করবেন না।

এই আইনের অধীন সংঘটিত অপরাধের আপোষ নিষ্পত্তি সংক্রান্ত বিধানঃ উক্ত আইনের ৮(১) ধারায় বলা হয়েছে, এই আইনের অধীন অপরাধের আপোষ নিষ্পত্তির জন্য সংশ্রিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা মেম্বার বা ক্ষেত্র মত সিটি কর্পোরেশনের মেয়র বা কাউন্সিলরের নিকট প্রেরণ করা যাবে।
*৮(২) ধারায় বলা হয়েছে যে, ৮(১) ধারা মতে কোন অভিযোগ আপোষ নিষ্পত্তির জন্য প্রেরিত হইলে সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যান, মেয়র, কাউন্সিলর বা মেম্বার উভয় পক্ষকে শুনানীর সুযোগ দিয়া নিষ্পত্তি করবেন এবং এরূপে নিষ্পত্তিকৃত অভিযোগ উপযুক্ত আদালত কর্তৃক নিষ্পত্তি হইয়াছে বলিয়া গণ্য হইবে।

লেখক : ড. আব্দুল্লাহ-আল-বাকী
আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, ঢাকা।

শেয়ার করুন

Comments are closed.




দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ © All rights reserved © 2024 Protidiner Kagoj |