রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:০৭ পূর্বাহ্ন
নিজস্ব সংবাদদাতা: বাবা মীর হোসেন পেশায় একজন অটোরিকশাচালক। চার মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে তার অভাবের সংসার। দ্বিতীয় মেয়ে সানজিদা আক্তার (২৯) দশম শ্রেণি থেকেই টিউশনি করে নিজের পড়ালেখার খরচ চালাতেন। পরিবারের পাশে দাঁড়াতে চাকরির আশায় পুলিশ কনস্টেবল পদের জন্য আবেদন করেন সানজিদা। নোয়াখালী জেলার পুলিশ কনস্টেবল পদের সবকয়টি ধাপে উত্তীর্ণও হয়েছেন তিনি। কিন্তু এতোটা কাছে এসেও স্বপ্ন পূরণে বাধা পড়ল যখন পুলিশ ভেরিফিকেশনে জানা গেল সানজিদা আক্তার ভূমিহীন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার মুছাপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা ছিলেন সানজিদার বাবা মীর হোসেন। তবে বর্তমানে পার্শ্ববর্তী রামপুর ইউনিয়নের একটি ভাড়া বাসায় ছেলে-মেয়ে নিয়ে থাকেন তিনি। অভাবের সংসারে টিউশনি আর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে নিজের পড়াশোনার খরচ চালান সানজিদা আক্তার। বৃহস্পতিবার (৪ এপ্রিল) রাত সাড়ে ৯টার দিকে নোয়াখালী জেলায় ট্রেইনি রিক্রুট পুলিশ কনস্টেবল (টিআরসি) পদে সানজিদাসহ ৭৮ তরুণ-তরুণীর নিয়োগের চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করা হয়। জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান নির্বাচিত প্রার্থীদের ফুল দিয়ে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান এবং উত্তীর্ণ প্রার্থীদের মিষ্টিমুখ করান। কিন্তু সানজিদার ঠোঁটে সেই হাসি বেশিদিন টিকল না। পুলিশ ভেরিফিকেশন শেষে জানা যায় সানজিদা আক্তার ভূমিহীন। ফলে তার চাকরি পাওয়া নিয়ে তৈরি হয় অনিশ্চয়তা। তবে সানজিদার পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস দিয়েছেন জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান।
সানজিদা আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি অনেক কষ্ট করে এই পর্যন্ত এসেছি। সরকারি মুজিব কলেজ থেকে বাণিজ্য বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়ে অনার্সে পড়ছি। আমার চাকরিটা হলে বাবা-মায়ের কষ্ট কমবে। চার বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে আমি দ্বিতীয়। ভূমিহীন হওয়া তো আমার অপরাধ না। যোগ্যতা অনুযায়ী সব ধাপের পরীক্ষায় আমি উত্তীর্ণ হয়েছি। সানজিদার মা নুর জাহান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার শ্বশুরের কোনো সম্পত্তি নেই। আমি ১৪ বছর ধরে মানুষের বাসায় ভাড়া থাকি। আমার স্বামী বিদেশ গিয়েও ফেরত আসে। পাঁচ সন্তান নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছি। এখনও কষ্ট করছি। মেয়ের চাকরিটা হলে আমাদের খুব উপকার হতো। আমার মেয়ে যদি যোগ্য হয় তাহলে তাকে যেন নিয়োগ দেওয়া হয়। এটা আমার মতো অসহায় মায়ের একমাত্র দাবি।
সানজিদার বাবা মীর হোসেন বলেন, আমার মেয়েটা অনেক কষ্ট করে চাকরিতে মনোনীত হয়েছে। আমি সিএনজি চালিয়ে সংসার চালাই। আমার দাদার নামে সম্পত্তি ছিল। অনেক আগে সেগুলো হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় আমরা ভূমিহীন হয়ে পড়েছি। আমার মেয়েকে চাকরি দিলে জেলা পুলিশ সুপার ও জেলা প্রশাসক স্যারের কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। মুছাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আইয়ুব আলী বলেন, আমার ইউনিয়ন থেকে ভূমিহীনের প্রত্যয়ন দিয়েছি। মেয়েটি সংগ্রামী এবং তার বাবাও সংগ্রামী। জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান স্যার পারেন মেয়েটার পাশে দাঁড়াতে। তিনি যদি খাস জমি দিতে পারেন তাহলে মেয়েটি আর ভূমিহীন থাকবে না। সে চাকরি করতে পারবে। তার মাধ্যমে পরিবারটি ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারবে।
নোয়াখালী জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) বিজয়া সেন বলেন, চাকরির নিয়ম অনুসারে পুলিশ ভেরিফিকেশন করতে হয়। আমরা তখন জানতে পারলাম সানজিদা আক্তার ভূমিহীন। তবে সে সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হয়েছে। বিষয়টি আমাদের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান স্যার জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান মহোদয়ের সঙ্গে কথা বলেন। জেলা প্রশাসক মহোদয় সানজিদাকে ভূমি দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন বলে জানায়। সব কিছু ঠিক থাকলে এই মাসের শেষের দিকে মেয়েটি প্রশিক্ষণে যেতে পারবে। মেয়েটির পাশে থাকতে পেরে পুলিশ প্রশাসন আনন্দিত।
জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান বলেন, আমার উপজেলা নির্বাহী অফিসার জানায় মেয়েটি মেধাবী, কষ্ট করে টিউশনি করে চাকরি পেয়েছে। ভূমিহীন হওয়ায় চাকরিটা মিলছে না। যাচাই-বাছাই করে আমরা তার আদি নিবাসের পাশের ওয়ার্ডে খাস জমিতে পাঁচ শতক জমির দলিল করে দিয়েছি। আমাদের সমাজ কল্যাণ পরিষদের একটা ফান্ড আছে সেখান থেকে তার জন্য ঘর করে দেওয়া হবে। তার একটি স্থায়ী ঠিকানা হবে। এছাড়া সে চাকরি পাওয়ার অধিকার পাবে। সে যে চাকরির বিবেচনাধীন আছে তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। পরবর্তী সময়ে সে প্রশিক্ষণেও যেতে পারবে। একজন যোগ্য প্রার্থী কেবল ভূমির অভাবে চাকরি থেকে বঞ্চিত হবে না। আমি মেয়েটি ও তার পরিবারের সফলতা কামনা করছি।