শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ১০:২২ অপরাহ্ন

আপডেট
বাঁশখালী উপকূলে বাণিজ্যিকভাবে ফিশিংবোট নির্মাণে বেড়েছে লোকের কর্মসংস্থান

বাঁশখালী উপকূলে বাণিজ্যিকভাবে ফিশিংবোট নির্মাণে বেড়েছে লোকের কর্মসংস্থান

শিব্বির আহমদ রানা, বাঁশখালী 
বাঁশখালীর পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের কোলঘেষে পুকুরিয়া, খানখানাবাদ, বাহারচরা, কাথরিয়া, সরল, গন্ডামারা, শীলকূপ, ছনুয়া, শেখেরখীল ইউনিয়ন নিয়ে প্রায় ৩৭ কিলোমিটার সমুদ্র সৈকত জুড়ে উপকূলবর্তী অঞ্চল। বাঁশখালীর বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর প্রায় সাড়ে ৪ লাখ লোকজন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বঙ্গোপসাগর ও শঙ্খ নদীকে ব্যবহার করে জীবন ও জীবীকা নির্বাহ করে চলছে। জীবনবাজি রেখে মৌসুমভিত্তিক জাল ফেলে, বোট চালিয়ে সমুদ্রের গভীরে গিয়ে মৎস্য আহরণ করে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন সহ দেশের মৎস্য চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখছে উপকূলের এ অঞ্চলের অধিকাংশ জেলে সম্প্রদায়। বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে বাঁশখালীর শেখেরখীল, ছনুয়া, বাংলাবাজার, সরকার বাজার, জালিয়াখালী বাজার, আরবশাহ বাজার, বাহারচরা ও খানখানাবাদ এলাকা ইকোনমিক জোনে রুপ নিয়েছে। এসব অঞ্চলে সমুদ্র থেকে আহরিত কয়েক কোটি টাকার মৎস্য প্রতিদিনই স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন হাঁটবাজারে। শুষ্ক মৌসুমে বঙ্গোপসাগর নির্ভর জেলে সম্প্রদায় মৎস্য আহরণের জন্য ট্রলার/ফিশিং বোট নির্মাণ করছে। এতে কয়েকহাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান হচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, বাঁশখালীর উপকূলীয় অঞ্চলে বিশেষ করে শেখেরখীল, পুঁইছড়ি অংশের আরবশাহ বাজার, বাংলাবাজার, সরকার বাজার, শীলকূপের পশ্চিম মনকিচর, জালিয়াখালী জলকদর পয়েন্ট, বাহারচরা এলাকায় সাগরে ইলিশ শিকার করা ফিশিং ট্রলার নির্মাণ হচ্ছে জলকদরের পাড়ে। সীমিত পরিসরে কাঠের তৈরি পণ্যবাহী ও ফিশিং ট্রলার, জেলেদের ছোট ছোট মাছ ধরার ট্রলারও নির্মাণ হচ্ছে। একাজে অভিজ্ঞ কারিগর নিপুণ হাতে নির্মাণ করছে কোটি টাকা মূল্যের কাঠের ফিশিংবোট।
বোট মালিক মো. সাজ্জাদ ও আমিনুর রহমানের সাথে কথা হলে তারা বলেন, প্রতিটি বোট নির্মাণের সাথে ১৫ থেকে ২০ জন শ্রমিক পারিশ্রমিকের বিনিময়ে দিয়ে যাচ্ছে শ্রম। কাঠের শিল্প এখানে স্বগৌরবে বিদ্যমান। বিগত বছরগুলোতে শুষ্ক মৌসুমে ট্রলার তৈরির ধুম পড়লেও এবার এই সংখ্যা কম। এখানে বোট বানানোর সাথে সংশ্লিষ্ট হাজার শ্রমিক। টেকনাফ, চকরিয়া, বাঁশখালীর কারিগররা এ বোট বানিয়ে নিজেদের পরিবারের কর্মসংস্থান করে। সাগরে জলদস্যুদের ভয়ে জেলেরা আতংকে থাকে। যার দরণ অনেক জেলে সাগরে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এ দিকে এবার সাগরে আশানুরূপ মাছ ধরা পড়েনি। বেশিরভাগ বোট মালিক লোকসান দিয়েছেন। তাই নতুন করে বোট বানাচ্ছেন না অনেকেই।
একেকটি বোট তৈরিতে প্রায় কোটি টাকার মতো ব্যয় হয় বলে জানিয়েছেন অভিজ্ঞ কারিগররা। তবে সাগরে জীবনবাজি রেখে মাছ শিকারে যাওয়া এসব ফিশিং ট্রলার যারা নির্মাণ করেন তাদের নেই প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা। অনুমান ও অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে নিপুণ হাতে তৈরি হয় কাঠের তৈরি এসব ট্রলার। তবে সার্বক্ষণিক বিদ্যুতের সুবিধা পেলে বোট নির্মাণের খরচ আরো অনেক কমে যাবে। প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারলে শ্রমিকদের দ্রুত কাজ করতে সুবিধা হবে।
সরেজমিনে জালীয়াখালী জলকদর খালের পশ্চিম মনকিচরে গিয়ে দেখা গেছে, জলকদরের তীরে বানানো হচ্ছে কাঠের কয়েকটি ট্রলার/ফিশিং বোট। এসব ট্রলার বানাতে কোনো ইঞ্জিনিয়ার কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষিত কোনো নকশাকার নেই।
কথা হয় ফিশিং ট্রলার বানানোর অভিজ্ঞ কারিগর বাঁশখালীর সরল ইউনিয়নের আব্দুল মান্নানের সাথে। ৪৫ বছর বয়সী এই কারিগর ১৯৯৭ সাল থেকে বোট তৈরির কাজে জড়িত। ২০০৬ সাল থেকে নিজের নেতৃত্বে বোট বানানো শুরু করেন তিনি। কারিগর মান্নান বলেন, আমি বাঁশখালীরই নামকরা মেস্ত্রি উস্তাদ মনির আহমদের কাছ থেকে ট্রলার বানানোর কাজ শিখেছি। এ পর্যন্ত প্রায় ১শ এর বেশী বোট বানিয়েছি। ৫ম শ্রেণি পাস এ কারিগর বলেন, এ মৌসুমে সাগরে মাছ কম ধরা পড়ছে। এতে বোট মালিকদের হাতে অর্থের সংকট রয়েছে, যে কারণে এ বছর নতুন বোট কম তৈরি হচ্ছে। বর্তমানে স্থানীয় বহদ্দার আমিনুর রহমানের যে বোটটা তৈরি করছি তার মোট ব্যয় ৮০ লক্ষ টাকার ওপর। তিনি বলেন, বোট তৈরি করার কাঠগুলো আসে থাইল্যান্ড ও আফ্রিকা থেকে। এসব কাঠের বর্গফুট মূল্য ২ হাজার ২শত টাকা। আমরা যে বোটটি তৈরি করছি এটি ৬০-৭০ লক্ষ টাকা মুল্যের ইলিশ শিকার করতে পারবে। ওজনে প্রায় ২শ থেকে ৩শ মণ মাছ শিকার করে আনতে পারবে। একটি বোট তৈরি করতে কম-বেশি এক কোটি টাকা ব্যয় হবে। একটি বোট তৈরিতে আমাদের মজুরি আছে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা। বোট তৈরিতে মূল মেস্ত্রির সাথে ১৫-২০ জন সাধারণ শ্রমিক থাকে। যাদের দৈনিক বেতন ৯ শত থেকে ১১শত টাকা।
বাঁশখালী ফিশিংবোট মালিক সমিতির অর্থ সম্পাদক মো. আব্দু শুক্কুর বলেন, প্রতি বছর সারা দেশে চারশ থেকে পাঁচশ ফিশিং ট্রলার তৈরি হয়। এর মধ্যে চট্টগ্রামে তৈরি হয় দেড়শ থেকে দুইশ। বাঁশখালীতে ছোট-মাঝারি ও বড় কাঠের তৈরি বোট নির্মাণ হয় ২০ থেকে ৩০টি। এ বছর সাগরে মাছ কম পড়েছে। অনেক ট্রলার মালিক এবার লোকসান গুণেছেন। যে কারণে এ বছর নতুন ট্রলার কম তৈরি হচ্ছে। সাগরে জলদস্যুদের ভয়ে অনেক জেলে তাদের পেশা ছেড়ে দিয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সহযোগীতায় যেভাবে সুন্দরবন জলদস্যুমুক্ত হয়েছে সেভাবে কক্সবাজার, কুতুবদিয়া, চট্টগ্রাম চ্যানেলকে দস্যুমুক্ত করলে এ অঞ্চলের জেলেরা স্বাধিনভাবে সাগরে ফিরতে সক্ষম হবে। এ জন্যে আমরা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।

শেয়ার করুন

Comments are closed.




দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ © All rights reserved © 2024 Protidiner Kagoj |