শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ১০:২৫ অপরাহ্ন

আপডেট
সচিবের এক সইয়ে সাবেক মন্ত্রী-এমপিসহ ৫০ জনের সাজা বাতিল

সচিবের এক সইয়ে সাবেক মন্ত্রী-এমপিসহ ৫০ জনের সাজা বাতিল

নিজস্ব সংবাদদাতা: ওয়ান-ইলেভেন সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ৬ মার্চ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে সাবেক স্বরাষ্ট্র্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরের বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানায় মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ওই বছরের ২৬ জুলাই তাকে ১০ বছরের সশ্রম ও তিন বছরের বিনাশ্রম সাজা দেয় বিচারিক আদালত। একই সঙ্গে ১০ লাখ টাকা জরিমানা ও তার অবৈধ সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার আদেশও দেওয়া হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর তিনি সাজা বাতিল চেয়ে উচ্চ আদালতে আপিল করেন। তার সম্পদবিবরণী জারির নোটিসে কমিশনের অনুমোদনের বদলে দুদকের সচিবের অনুমোদন নিয়ে মামলা করায় তার সাজা বাতিল করে উচ্চ আদালত। পরে তার সাজা বাতিল-সংক্রান্ত আদেশের পর্যবেক্ষণ অনুসরণ করে সাবেক মন্ত্রী, এমপি, আমলাসহ ৫০ জনের সাজা বাতিল বা স্থগিত হয়। তাদের অনেকের ১৩ বছরের সাজা হয়েছিল। দুদক কর্মকর্তা বলেছেন, যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় দুদকের অনুসন্ধান-তদন্ত হয়নি বলে তাদের সাজা বাতিল বা স্থগিত হয়।দুদকের কর্মকর্তারা বলেছেন, দেশে জরুরি অবস্থা চলাকালে লে. জেনারেল (অব.) হাসান মশহুদ চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন কমিশন অনুসন্ধান ও তদন্ত দ্রুত সম্পন্ন করতে ৬১টি টাস্কফোর্স গঠন করেছিলেন।

প্রতিটি টিমের প্রধান ছিলেন সেনাবাহিনীর একজন মেজর বা সমমর্যাদার নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর কর্মকর্তা। টিমের অন্য চারজনের মধ্যে দুদকের একজন, সিআইডির একজন, র‌্যাবের একজন ও এনবিআরের একজন ছিলেন। প্রতিটি টিম একজনের দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান ও তদন্ত করতেন। জরুরি ক্ষমতার বিধিমালা অনুযায়ী তখন ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সম্পদের হিসাব জমা দেওয়া হতো। ওই সময় একশোর বেশি প্রভাবশালী রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ও আমলার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। আসামিদের সাজাও হয়েছিল। অভিযুক্তদের দুর্নীতির ঘটনাও প্রায় একই ছিল। যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় অনুসন্ধান ও তদন্ত না হওয়ায় আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ৫০ জনের সাজা বাতিল বা স্থগিত করে উচ্চ আদালত। দুদকের একজন মহাপরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দেশে জরুরি অবস্থা জারি হয়। ৬ ফেব্রুয়ারি দুদকের তৎকালীন চেয়ারম্যান বিচারপতি সুলতান হোসেন খানসহ কমিশনাররা পদত্যাগ করেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি সাবেক লে. জেনারেল হাসান মশহুদ চৌধুরী দুদকের চেয়ারম্যান হন। মধ্যবর্তী ১৮ দিন কোনো কমিশন ছিল না।

২০০৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রথম দুর্নীতিবাজদের তালিকা প্রকাশ করে দুদক। এ তালিকায় ৫০ জনের নাম ছিল। দুদকের অনুসন্ধান দ্রুত সম্পন্ন করতে কমিশনের অনুপস্থিতিতে তৎকালীন দুদক সচিব দেলোয়ার হোসেন সম্পদবিবরণী জারির নোটিসে স্বাক্ষর করেন। ওই নোটিসের ভিত্তিতেই অনুসন্ধান সম্পন্ন হয় এবং অভিযুক্তদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে সম্পদের তথ্য গোপন করা ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের জন্য মামলা হয়। তদন্ত শেষে বিচারিক আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়। বিচারিক আদালত তাদের প্রত্যেককে ১৩ বছরের সাজা দেয়। তিনি বলেন, ‘দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪ অনুযায়ী সব ক্ষমতার মালিক কমিশন। একজন চেয়ারম্যান ও দুজন কমিশনার নিয়ে এ কমিশন গঠিত। ২০০৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কমিশন ছিল না। ওই সময়ে দুদকের সচিবের স্বাক্ষর করা নোটিসের অভিযুক্তদের অনুসন্ধান শেষ করে মামলা হয়। দুদক আইন অনুযায়ী সচিব নোটিস জারির অনুমোদন দিতে পারেন না। এ কারণে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর সাজাপ্রাপ্ত অনেকে উচ্চ আদালতে আপিল করেন।

আদালত দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্ত যথাযথ না হওয়ায় প্রথমে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরের সাজা বাতিল করে। পরে তার সাজা বাতিলের আদেশের পর্যবেক্ষণ অনুসরণ করে সাবেক মন্ত্রী, এমপি, আমলাসহ ৫০ জন তাদের সাজা বাতিল বা স্থগিত চেয়ে উচ্চ আদালতে আপিল করেন। উচ্চ আদালত পর্যায়ক্রমে তাদের সাজা বাতিল বা স্থগিত করার আদেশ দেয়। তালিকায় অন্য যাদের নাম রয়েছে, তারা হলেন আওয়ামী লীগের সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, সাবেক মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, সাবেক মন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল, জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাবেক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ, সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, সাবেক এমপি শামীম ওসমান, ডা. এইচ বি এম ইকবাল, জয়নাল হাজারী, এসএম মোস্তফা রশীদ সুজা, হাজী সেলিম, হাজী মকবুল ও পংকজ দেবনাথ। বিএনপির হারিস চৌধুরী, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী, তরিকুল ইসলাম, আমান উল্লাহ, মীর মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন এবং সাবেক সচিব আ ন হ আখতার, সোনালী ব্যাংক সিবিএ সভাপতি বিএম বাকির হোসেন ও টিঅ্যান্ডটি সিবিএ সভাপতি ফিরোজ মিয়াও মামলার আসামি ছিলেন।

দুদকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে জরুরি অবস্থা জারির প্রধান কারণ ছিল দুটি। প্রথমত, দেশের বিবদমান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার হিংসাত্মক ঘটনার অবসান ঘটানো। দ্বিতীয়ত, দেশের প্রভাবশালী ব্যক্তি যারা গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দুর্নীতিতে লিপ্ত ছিলেন, তাদের বিচারের সম্মুখীন করা। ওই সময়ে দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্তরা দুদকের বিরুদ্ধে হাইকোর্টের বিভিন্ন বিভাগে তিন শতাধিক রিট ও ফৌজদারি মামলা করেন। বেশিরভাগ রিট হয় দুদক থেকে অভিযুক্তদের কাছে সম্পদবিবরণী পাঠানোর নোটিসের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে। হাইকোর্টের একটি বেঞ্চেই ২৩০টি রিট হয়। ২০০৭ ও ২০০৮ সালে রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, আমলা ও পুলিশের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ১০২টি দুর্নীতির মামলা হয়েছিল। ৭৫টি মামলায় সাজা হয়েছিল।

শেয়ার করুন

Comments are closed.




দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ © All rights reserved © 2024 Protidiner Kagoj |