রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৪৪ পূর্বাহ্ন

এবার অর্ধশত কারা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে দুদক

এবার অর্ধশত কারা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে দুদক

এবার অর্ধশত কারা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে দুদক

বিশেষ প্রতিনিধি: দেশের বিভিন্ন কারাগার চলছে লাগামহীন দুর্নীতি। সাবেক ও বর্তমান আইজি, ডিআইজি প্রিজনসহ ৫৫ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক। দেশের বিভিন্ন কারাগারে অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে সাবেক দুই আইজি প্রিজন্স, বর্তমান ৮ ডিআইজি প্রিজন, ২২জন জেল সুপার, ১৮ জন জেলার,খুলনার জেল সুপারসহ অর্ধশত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এবার অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। সংস্থাটির সবশেষ অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, দেশের বেশিরভাগ কারাগারে চলছে লাগামহীন দুর্নীতি, । এসব দুর্নীতিতে কারাগারের উচ্চ পর্যায় থেকে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারি জড়িত। দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, কারাগারের ভেতর রয়েছে দুর্নীতির মহাচক্র।

 

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অর্থের বিনিময়ে বন্দিদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ মিলে, টাকা খসালেই পাওয়া যায় সিট, নির্ধারিত মূল্যের বাইরে বিক্রি হচ্ছে খাবার, আর জামিন বাণিজ্যতো রয়েছেই। কারাগারে দুর্নীতি করে বিপুল সম্পদের মালিক বনেছেন। এমন অভিযোগে সম্প্রতি দুদকের জিজ্ঞাসাবাদের মুখেও পড়েন কয়েক কারা কর্মকর্তা। দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগে সাবেক দুই আইজি প্রিজন্স, বর্তমান ৮ ডিআইজি প্রিজন, ২২জন জেল সুপার, ময়মনসিংহের সাবেক জেলারসহ অর্ধশত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এবার অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। দেশে যখন সাবেক আইজিপি,মতিউর কান্ডসহ একাদিক ব্যাক্তির দুর্নীতি প্রকাশ হলে এবার কারা কর্মকর্তাদের দুর্নীতি সামনে আসে। কয়েকজন কর্মকর্তা শতকোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। নিজ জেলাসহ রাজধানীতে একাদিক বাড়ি,ফ্ল্যাট,জমি কিনেছেন। একজন জেল সুপার ও তিন জন জেলারের শতকোটি টাকার সম্পদের সন্ধান পেয়েছে দুদক। এবার বেনজির ও মতিউর রহমান কান্ডের পর কারা কর্মকর্তাদের নিয়ে মিডিয়া দুর্নীতির খবর প্রকাশ হতে থাকে।

 

এরই মধ্যে দুদকের কর্মকর্তরা মাঠে নামে। এছাড়া যাদের নাম আলোচনায় আসে সিনিয়র জেল সুপার সুভাষ কুমার ঘোষ, সিনিয়র জেল সুপার আব্দুল জলিল, জেল সুপার বজলুর রশিদ আকন্দ, জেলার আবু সায়েম, সিনিয়র জেল সুপার সুব্রত কুমার বালা, সিনিয়র জেল সুপার ইকবাল কবির চৌধুরীসহ দেশের বিভিন্ন কারাগারে দায়িত্বরত অর্ধশত কারা কর্মকর্তার নাম রয়েছে দুদকের অনুসন্ধানের ফাইলে। দুদক কমিশনার বলছেন, দুর্নীতিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে তারা আইনি ব্যবস্থা নিবেন। বিভিন্ন কারাগারে আমাদের নজরদারী আছে। দুদকের গোয়েন্দা সংস্থা সেখানে কাজ করছে। যেখানেই দুর্নীতির সন্ধান পাবো, সেখানেই দুদকের হস্তক্ষেপ থাকবে। বছরের পর বছর দেশের বিভিন্ন কারাগারে দুর্নীতি চলতে থাকলেও দুদক এবং কারা কর্তৃপক্ষ হাতেগোনো কয়েকজনের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিতে পেরেছে। অপরাধে জড়িত কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে পারলেই দুর্নীতিমুক্ত হবে কারাগার।

 

দুর্নীতিতে নিমজ্জিত কারা অধিদফতরের নানা অনিয়ম ও সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। এরই মধ্যে কারা অধিদফতরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সেগুনবাগিচার দুদক কার্যালয়ে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এর আগে গত মাসেও কারাগারের তিন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। সংশ্লিষ্টরা জানান, আরও বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে শিগগিরই ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের তথ্য পাওয়া যাবে, তাদের বিরুদ্ধে কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে মামলা দায়ের করা হবে। এদিকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদের পর বিষয়টি নিয়ে অধিদফতরে তোলপাড় শুরু হয়েছে। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আতঙ্কের মধ্যে দিন পার করছেন। তারা অতীতের মতো সিন্ডিকেট তৈরি করে এই অনুসন্ধান বন্ধ করার জন্য নানাভাবে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। দুদক সচিব জানিয়েছেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে কারা কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। কোনও ব্যক্তি বিশেষের ওপর টার্গেট করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে না।

 

যার বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া যাবে, দুর্নীতি দমন কমিশনের আইন ও বিধি মোতাবেক তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করা হবে। দুর্নীতির বিষয়ে প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হলে, তাদের বিরুদ্ধে পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দীর্ঘ দিন ধরেই কারা অধিদফতর নানা অনিয়ম ও দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়ে আছে। কারা প্রশাসনের কেউ দুর্নীতি দমনে শক্ত ব্যবস্থা নিতে চাইলে অধিদফতরের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট নানাভাবে সেই কর্মকর্তাকে হেনস্তা করে। একারণে কারাগারের দুর্নীতি নিয়ে নানা আলোচনা হলেও তা দমনে কোনও উদ্যোগ দেখা যায়নি। কিন্তু ২০১৮ সালের ২৬ অক্টোবর চট্টগ্রাম থেকে ময়মনসিংহগামী বিজয় এক্সপ্রেস থেকে কারা কর্মকর্তা সোহেল রানা বিশ্বাসকে নগদ ৪৪ লাখ টাকা ও কয়েক কোটি টাকার চেকসহ রেলওয়ে পুলিশ আটকের পর বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। আটকের পর সোহেল রানা জানান, অবৈধভাবে উপার্জিত এসব অর্থ তিনি বিভিন্ন কর্মকর্তাকে দেওয়ার জন্য নিয়েছিলেন। পরে বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন। প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে গত বছরের নভেম্বর চট্টগ্রামের সাবেক জেলার সোহেল রানার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করা হয়। একই সঙ্গে কারাগারের যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দুদক সূত্র জানায়, এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৬ ফেব্রুয়ারি জেল সুপার ইকবাল কবীর চৌধুরী,আব্দুল জলিল, জেলার হাবিবুর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। দুদকের সহকারী পরিচালক মো. সাইদুজ্জামানের নেতৃত্বে একটি টিম তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এছাড়াও ডিআইজি প্রিজন) সগীর মিয়া, জেল সুপার গিয়াস উদ্দিন মোল্লা ও জেল সুপার মোখলেসুর রহমানকে জিজ্ঞাসাবদ করা হয়।

দুদক সূত্র জানায়, কারাগারে সিট বাণিজ্য, বন্দি বাণিজ্য, খাবারে অনিয়ম, মাদক কারবার, টাকার বিনিময়ে বন্দিদের বিশেষ সুবিধা, মোবাইল ফোন ব্যবহারসহ বিশেষ ব্যবস্থায় নারীসঙ্গের ব্যবস্থা করে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। এছাড়া কারাগারের ভেতরে টাকার বিনিময়ে কারা হাসপাতালে থাকার ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। কারা অধিদফতরের নিয়োগ ও বিভিন্ন কেনাকাটায় ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া টাকা ছাড়া বন্দিদের সঙ্গে স্বজন ও আইনজীবীদের সাক্ষাৎ মেলে না। কেউ মামলা থেকে জামিন পেলে সেই প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করা এবং আরেক মামলায় গ্রেফতার দেখানোর ভয় দেখিয়েও গেইট থেকেই অর্থ আদায় করা হয়। কারা সূত্র জানায়, কারাগারের উন্নয়নের নামে ব্যাপক দুর্নীতি হয়ে থাকে। এর আগে কারারক্ষী নিয়োগে স্বরাষ্ট মন্ত্রণালয়ের অনুসন্ধানেও ব্যাপক অনিয়মের তথ্য পাওয়া গেছে। এক জেলার প্রার্থী হয়েও অন্য জেলার কোটায় নিয়োগের বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ার পরও প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের কারণে কারও বিরুদ্ধে বিভাগীয় কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

ওই সূত্র জানায়, কারাগারের দুই জন ডিআইজি প্রিজনসহ কয়েকজন জেল সুপার ও জেলারের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। কারও বিরুদ্ধে কোনও অনিয়মের অভিযোগে ব্যবস্থা নিতে গেলেই তারা নানাভাবে তা বানচাল করে দেয়। কারা সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দুদক যেভাবে কারা কর্মকর্তাদের সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করেছে, ধারাবাহিকভাবে তা করলে কারা অধিফতরের বেশিরভাগ কর্মকর্তার অবৈধভাবে উপার্জিত বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের তথ্য পাওয়া যাবে। এজন্য বিষয়টি নিয়ে অসাধু কারা কর্মকর্তাদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। সম্পদ বিবরণী দাখিলের নোটিশ যেন দুদক না দেয় সেজন্য তারা নানাভাবে তদবির করছেন। সংশ্লিষ্টরা জানান, কারাগারের ভেতরে টাকা দিলে সবকিছু পাওয়ার বিষয়টি ওপেন সিক্রেট। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়া একাধিক অপরাধীর সঙ্গে এই প্রতিবেদকের আলাপকালেও কারা অভ্যন্তরে টাকার বিনিময়ে সব সুবিধা পাওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে।

শেয়ার করুন

Comments are closed.




দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ © All rights reserved © 2024 Protidiner Kagoj |