শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০২:২২ পূর্বাহ্ন
গৌরীপুরে ৪৭ কোটি, হালুয়াঘাটে ৩৭ কোটি, ফুলবাড়ীয়ায় ৪৪ কোটি ও ত্রিশালে ৪৩ কোটি বরাদ্দকৃত টাকা ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্ম সনদ তৈরী করে ‘ছাত্রলীগ’নেতাকর্মী প্রশিক্ষণার্থী বানিয়ে বিপুল পরিমান অর্থ আত্মসাত করেছেন কর্মকর্তারা।
খাইরুল ইসলাম আল আমিন: আওয়ামী লীগ সরকারের টানা ১৬ বছরের শাসনামলে নিয়োগ পেয়েছেন প্রায় সাত লাখ। তাদের সঙ্গে ওই সময়ে পদোন্নতি পাওয়া আরও সাড়ে তিন লাখের বেশি যোগ হবে। সবমিলিয়ে সরাসরি নিয়োগ ও পদোন্নতির মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের ‘সুবিধাভোগী’ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যাটা দাঁড়ায় ১০ লাখ ৫০ হাজার ৬৮৩ জনে, যা প্রশাসনে হিমালয়ের মতো বিশাল এক খাম্বা। শূন্য পদ বাদে বর্তমানে কর্মরত মোট ১২ লাখ ৩১ হাজার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে তাদের খুঁজে বের করতে গেলে লোম বাছতে কম্বল উজাড় হওয়ার জোগাড় হবে বলে মনে করছেন প্রশাসন সংশ্লিষ্টরা।
ময়মনসিংহ যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচি প্রকল্পে বেকার যুবক, যুবতীদের প্রশিক্ষণ প্রদান না করে কর্মসূচির আওতায় বেশিরভাগই চাকরি পায় স্থানীয় “ছাত্রলীগ”নেতা-কর্মীরা। প্রশিক্ষকের সম্মানীভাতা, মাঠকর্মীদের বেতন ও ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে স্থানীয় উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা/সাবেক ডিডি ফারজানা পারভিনের যোগসাজশে সব টাকা হরিলুট করেছেন। ময়মনসিংহের সাবেক ডিডি ফারজানা পারভিনসহ ১০/১৩ জন কর্মকর্তা নামে-বেনামে ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্ম সনদ তৈরী করে ২শ’ ৯২ কোটি ১১ লাখ ৫শ” ১২ টাকা বরাদ্দের বিপুল অর্থ আত্নসাত ও অপচয় করেছেন।এ অভিযোগে সাবেক উপ- পরিচালকসহ ৭ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা হয়েছে। ময়মনসিংহ বিজ্ঞ জেলা ও দায়রা জজ ও সিনিয়র বিশেষ জজ আদালতে গতবছর ১৮ জানুয়ারি এ মামলা করা হয়। আদালতের নির্দেশে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ময়মনসিংহ জেলা শাখার উপসহকারী আনিসুর রহমান ও শাহজাহানকে তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেন। জনপ্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মতে গত ১৫ বছরে প্রায় সবই দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিছু লোক ঢুকে পড়েছে যারা কোনোমতেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না। তারা নানা কায়দা-কানুন করে চাকরিতে ঢুকেছে। কিছু লোক টাকার বিনিময়ে ঢুকেছে। প্রশাসনের জানামতে ভিন্নমতের লোকদের চাকরিতে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। আওয়ামী লীগের বাইরে যেন কেউ ঢুকতে না পারে সেজন্য দফায় দফায় তথ্য যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। বিশেষ করে ক্যাডার সার্ভিস ও কিছু নন-ক্যাডার সার্ভিসে নিয়োগ দেওয়ার আগে দুটি সংস্থাকে দিয়ে প্রার্থীর তথ্য যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। এরপরও সন্দেহ হলে জেলা প্রশাসন পুনরায় তদন্ত করেছে। সাধারণ চাকরিপ্রার্থীদের বলতে হয়েছে তারা আওয়ামী লীগ সমর্থক। আর লিখিত বা মৌখিক পরীক্ষায় যত ভালো করুক না কেন জামায়াত ও বিএনপি নেতাকর্মীদের জন্য চাকরিতে ঢোকা ছিল লোককাহিনি বেহুলা-লক্ষ্মীন্দরের বাসরঘরে প্রবেশের মতোই কঠিন।
ন্যাশনাল সার্ভিসে অনিয়ম : ঘরে ঘরে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ২০১০ সালে ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচি চালু করা হয়েছিল। এ কর্মসূচির আওতায় বেকার যুবক ও নারীদের তিন মাস প্রশিক্ষণের পর সরকারি প্রতিষ্ঠানে দুই বছরের জন্য অস্থায়ী চাকরি দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণকালে প্রতিদিন ১০০ টাকা ভাতা আর চাকরিতে যোগদানের পর প্রতি মাসে ৬ হাজার টাকা বেতন দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে ১৩ বছরে এই কর্মসূচিতে ব্যয় হয়েছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। বিপুল এই টাকায় বেকার যুবক-নারীদের কর্মসংস্থানের কথা থাকলেও নানা কায়দায় এর উল্লেখযোগ্য অংশ আত্মসাৎ করা হয়েছে। এই কর্মসূচির মাধ্যমে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ময়মনসিংহসহ সারাদেশে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদেরই বাছাই ও চাকরি দেওয়া হয়। ন্যাশনাল সার্ভিসে সাধারণ বেকারদের অংশ নেওয়ার সুযোগ হয়নি। ময়মনসিংহ যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের সাবেক উপ-পরিচালক ফারজানা পারভিনের স্বামী বাংলাদেশ কৃষি বিদ্যালয়ের কর্মকর্তা খাইরুল ইসলাম।তিনি বাকৃবি আ,লীগ পন্থী অফিসার পরিষদের সভাপতি। স্বামীর প্রভাবে ময়মনসিংহ যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের সাবেক উপ-পরিচালক ফারজানা পারভিন ময়মনসিংহ যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচি প্রকল্পের ২শ’ ৯২ কোটি ১১ লাখ ৫শ” ১২ টাকা বরাদ্দের বিপুল অর্থ আত্নসাত করেছেন।
এছাড়াও সাবেক সহকারি পরিচালক নুরুজ্জামান চৌধুরী, (বর্তমানে ডিডি শেরপুর) সাবেক সহকারি পরিচালক মো: জোয়াহের আলী মিয়া বর্তমানে (অব:), গৌরীপুর উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা নদ্দন কুমার দেবনাথ, সাবেক ত্রিশাল উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা মো: আবু জুলহাস,ফুলবাড়ীয়া উপজেলার সাবেক যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা নূর মোহাম্মদ ও গোলাম মোস্তফাসহ কয়েকজন। যুব মন্ত্রনালয়ে কর্মরত আ,লীগ দাবিদার উপসচিব ডাঃ জহিরুল ইসলাম এই দুর্নীতির মহা নায়ক। ন্যাশানাল সার্ভিস প্রকল্পের ২শ’ ৯২ কোটি ১১ লাখ ৫শ” ১২ টাকা বরাদ্দের বিপুল অর্থ আত্নসাত ও অপচয়ের অভিযোগে এ মামলা হয়। বাদী তার মামলার আবেদনে উল্লেখ করেন, গত ২০ জুলাই ২০১৭ ইং হতে ২০২১ সালের ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত ময়মনসিংহ জেলা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের দায়িত্বে ছিলেন তন্মধ্যে এখনও এদের কেউ কেউ বিভিন্ন উপজেলায় কর্মরত আছেন,কেউ অবসরেও চলে গেছেন।
উপরোল্লিখিত প্রকল্পের ২৯২ কোটি টাকার মধ্যে ৪টি উপজেলায় ১৮০ কোটি টাকা আত্নসাত ও অপচয় করা হয়েছে। গৌরীপুর উপজেলায় বরাদ্দকৃত ৫২ কোটি টাকার মধ্যে ব্যয় করা হয়েছে ৪৭ কোটি টাকা, হালুয়াঘাটে ৩৭ কোটি টাকা, ফুলবাড়ীয়ায় ৪৪ কোটি টাকা, ত্রিশালে ৪৩ কোটি টাকা। অভিযোগে বলা হয়, উপরোক্তদের পারস্পরিক যোগসাজশে প্রশিক্ষণ প্যানেল এবং ১০টি নির্ধারিত মডিউলের ভিত্তিতে দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণ পরিচালনা করার দায়িত্বে থাকলেও অভিযুক্তরা সঠিকভাবে দায়িত্বপালন না করে সরকারি টাকা আত্নসাত ও অপচয় করেছেন । উপজেলা সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও সদস্যসচিব উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা অধিকাংশ কর্মকর্তা ক্লাস- পাঠদান পরিচালনা করেছেন, যা ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচীর প্রশিক্ষণ পাঠক্রম বেআইনীভাবে লঙ্ঘন করেছেন। ময়মনসিংহের সাবেক ডিডি ফারজানা পারভিন ক্ষমতা অপব্যবহার করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের নামে অতিরিক্ত ক্লাস দেখিয়ে উক্ত টাকা আত্নসাত করেন। তিনি তার সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সকল উপলোয় সিন্ডিকেট গড়ে তুলেন। ত্রিশাল উপজেলায় ৪৩ কোটি টাকা বরাদ্দের অংশ নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলে, ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। উক্ত কমিটিতে তাদের দুর্নীতি, ভুয়া ব্যাংক হিসাব দেখিয়ে টাকা উত্তোলন করেছেন এবং ৫৩ লক্ষ টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরৎ দেয়ার জন্য সুপারিশ করে তদন্ত কমিটি। পরবর্তীতে ত্রিশাল যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা আবু জুলহাসের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা চালু করে তাকে বদলী করা হয় হালুয়াঘাট উপজেলায়।
জেলার একাধিক উপজেলায় একই দিনে কয়েকশ’ কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিয়ে প্রশিক্ষণ দেখিয়েছেন। উপরোক্ত রাস্তা এই অল্প সময়ে যাতায়াত অসম্ভব হলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয় । ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচীর আওতায় প্রশিক্ষণের সময় ছিল এক ব্যাচ সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত মোট ৪ ঘন্টা। দ্বিতীয় ব্যাচ ছিল দুপুর ২টা থেকে ৫টা মোট ৪ ঘন্টা। ১০টি নির্ধারিত মডিউল অনুয়ায়ি সিডিউল- বিষয় ভিত্তিক কর্মকর্তাদের নামে এক বিপুল ক্লাসের উল্লেখছিল যা দুর্নীতি ও ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে করা হয়েছে। ময়মনসিংহ যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের সাবেক ডিডি ফারজানা পারভিন ত্রিশাল উপজেলায় ৪৫২টি ক্লাস, এডি নুরুজ্জামান চৌধুরী ৪৩৪টি, জোয়াহের আলী মিয়া ৪৩৪টি, আবু জুলহাস ৮৩৩টি, উপজেলা একাডেমি সুপারভাইজার সাহানা আক্তার ৪২০টি, ডাক্তার ওয়াজিদ আহমেদ ৬৬৮টি, উপজেলা রিসোর্স সেন্টারের ইন্সপেক্টর মতিউর রহমান ৫৪৮টি, ত্রিশাল ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক সাবিনা ইয়াসমিন ৬৬৮টি, স্ট্রোকে আক্তান্ত রোগি যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের প্রশিক্ষক ( মৎস ) বদরুজ্জামান ফকির ৭০০টি, যুব উন্নয়ন অদিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ের সহকারি পরিচালক আবুল বাশার ২২০টি। এভাবে প্রত্যেকটি উপজেলায় দেখানো হয়েছে ভুয়া ক্লাস। এর মধ্যে ন্যাশানাল সার্ভিসের আওতায় বেকার যুবক-যুবতিদের নিয়োগ না দিয়ে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের নিয়োগ দিয়ে ৬টি উপজেলায় প্রায় ১৮০ কোটি টাকা দুর্নীতি,অপচয় এবং বিভিন্ন ব্যাংকে ভুয়া তালিকা দিয়ে টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। মোট ক্লাস দেখানো হয়েছে- ময়মনসিংহের সাবেক ডিডি ফারজানা পারভিনের নামে ১৮৪৮টি ক্লাস, নুরুজ্জামান চৌধুরি ১৭০৮টি, জোয়াহের আলী ১৭০৪টি, নন্দন কুমার দেবনাথ ১২৫৭টি, নুর মোহাম্মদ ১০৮৫টি, আবু জুলহাস ৮৩৩টিসহ ১০টি উপজেলায় একইভাবে ভুয়া ও ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের ক্লাস দেখিয়েছেন তারা।
সরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে নামমাত্র এইসব টাকা লেনদেন না করে বিতরণ করেছেন ডাচবাংলা ব্যাংকের মাধ্যমে। সার্ভিসের আওতায় মাঠকর্মীদের ব্যাংক হিসাব জাতীয় পরিচয়র পত্র দিয়ে খোলার নির্দেশনা বাধ্যতামূলক থাকলেও তারা বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা ও সংশ্লিস্ট সরকারি কর্মকর্তাদের যোগসাজশে জন্মনিবন্ধন দিয়ে ব্যাংক হিসাব খুলে টাকা উত্তোলন করেছেন্য। জেলার ত্রিশাল উপজেলায় তদন্তে প্রমান মিলেছে জেলা প্রশাসকের তদন্ত কমিটির রিপোর্টে। এথেকে প্রতিয়মান হয় যে, কর্মসূচীর আওয়াতায় জেলার সকল উপজেলায় একই দুর্নীতি অনিয়ম ও অপচয়ের ঘটনা ঘটেছে। ইতিপূর্বেও এই সংক্রান্ত বিষয় তদন্ত ও উপরোক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বরাবর অভিযোগ করা হয়েছে। কিন্তু যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রনালয়ের সাবেক সচিব ড.মহিউদ্দিনের যোগসাজশে সারাদেশে তিনহাজার কোটি টাকা বরাদ্দের মধ্যে প্রায় ৬০% টাকা লুটপাট করা হয়। এঘটনায় ময়মনসিংহ বিজ্ঞ জেলা জজ, দায়রা জজ ও সিনিয়র বিশেষ জজ আদালতে এ মামলার আবেদন করা হয়। বাদী আশা করেন বিজ্ঞ আদালতের মাধ্যমে দুর্নীতির সরকারি অর্থ, অপচয় রোধ এবং আত্বসাতকৃত টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরৎ আনা সম্ভব হবে। এবিষয়ে জানতে ফারজানা পারভিনের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও,তিনি রিসিভ করেননি এমনকি ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি উত্তর দেননি । মামলার আবেদনে ধারা উল্লেখ করা হয়েছে দন্ডবিধি ৪০৯ ধারা তৎসহ ১৯৪৭ সনের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২)। মোকদ্দমা নং- ০১/২০২৩ ইং।