Noman Group Advertisement

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে ৪০০ কোটি টাকার ময়লা বাণিজ্য

রেজাউল করিম রেজা , বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ০৪:৪৮ পিএম

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) প্রধান কাজ ময়লা ব্যবস্থাপনা, সড়ক বাতি ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন। এজন্য নগরবাসীর কাছ থেকে টাকা আদায় করে চসিক। তারপরও ময়লা ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে। যারা নগরবাসীর কাছ থেকে টাকার বিনিময়ে ময়লা সংগ্রহ করবে। প্রাথমিকভাবে ২৪ ওয়ার্ডে দায়িত্ব পেয়েছে ২৪টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। অভিযোগ উঠেছে, অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের মালিক বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা। যদিও চসিকের যুক্তি, ঘর থেকে ময়লা সংগ্রহ তাদের দায়িত্ব নয়। তারা নির্দিষ্ট স্থান থেকে ময়লা সংগ্রহ করবে। অথচ ঘর থেকে ময়লা সংগ্রহের জন্য প্রায় দুই হাজার লোক নিয়োগ দিয়েছিল সিটি কর্পোরেশন।

এখন আবার নতুন করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া মানে নগরবাসীকে ময়লার জন্য করের টাকার পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে টাকা দিতে হবে। জানা গেছে, সম্প্রতি ৪১টি ওয়ার্ডে বর্জ্য সংগ্রহের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়। এতে ১৯১টি প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দেয়। দরপত্র মূল্যায়ন শেষে ২৪টি প্রতিষ্ঠানকে ২৪ ওয়ার্ডের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বাকি ওয়ার্ডগুলোতে প্রতিষ্ঠান নিয়োগের কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। কাজ পাওয়া ১৬টি প্রতিষ্ঠানের নামও জানা গেছে। ৮ নম্বর শুলকবহর ওয়ার্ডে কাজ পেয়েছে মেসার্স মাতৃভূমি এন্টারপ্রাইজ। প্রতিষ্ঠানটির মালিক নগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য সচিব জমির উদ্দিন নাহিদ। ৭ নম্বর পশ্চিম ষোলশহর ওয়ার্ডে কাজ পেয়েছে এসআরএস এন্টারপ্রাইজ।

প্রতিষ্ঠানটির মালিক নগর যুবদলের সাবেক সহসভাপতি মোহাম্মদ আলী সাকি। ৩৪ নম্বর পাথরঘাটা ওয়ার্ডে কাজ পেয়েছেন কোতোয়ালি থানা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক শাহাদাত হোসেন নাবিলের প্রতিষ্ঠান নাবিল এন্টারপ্রাইজ। ৩৫ নম্বর বক্সিরহাট ওয়ার্ডে কাজ পেয়েছেন মেসার্স রিমন কনস্ট্রাকশনের মালিক মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক এন মো. রিমন। ৯ নম্বর উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডে কাজ পেয়েছেন অ্যাকুয়া রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের মালিক ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি হুমায়ুন কবির চৌধুরী রুদ্র। ১০ নম্বর উত্তর কাট্টলী ওয়ার্ডে কাজ পেয়েছেন  মেসার্স মদিনা এন্টারপ্রাইজের মালিক ওয়ার্ড বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মো. আলাউদ্দিন, ৫ নম্বর মোহরা ওয়ার্ডের কাজ পেয়েছেন নগর ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি নিয়াজ মোর্শেদ খান, ৩ নম্বর পাঁচলাইশ ওয়ার্ডে কাজ পেয়েছেন গ্রিন এন্টারপ্রাইজের মালিক যুবদল নেতা মো. ইমতিয়াজুর রহমান, ৩৬ নম্বর গোসাইলডাঙ্গা ওয়ার্ডে কাজ পেয়েছেন বিন ফুয়াদ এন্টারপ্রাইজের মালিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাবেক সহসম্পাদক ফারহান ফুয়াদ, ৩৭ নম্বর উত্তর মধ্যম হালিশহর ওয়ার্ডে কাজ পেয়েছেন মেসার্স এস এ ট্রেডার্সের মালিক সাবেক ওয়ার্ড ছাত্রদল নেতা শাহিনূর ইসলাম।  দায়িত্ব পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর অতীত অভিজ্ঞতা নেই।

এছাড়া নেই পর্যাপ্ত জনবল, রিকশা-ভ্যান, হাতগাড়ি, ইঞ্জিন ট্রলি ও অন্যান্য সরঞ্জাম। অথচ বাসা-বাড়ি ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে অন্তত ৩৫০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা ব্যবসা করবে দায়িত্ব পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো। অভিযোগ উঠেছে, অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের মালিক বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা ৩৯ নম্বর দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ডে কাজ পেয়েছেন লাইমেক্স মাল্টি ট্রেডের মালিক বিএনপি সমর্থিত জামসেদ হোসেন, ৪ নম্বর চান্দগাঁও ওয়ার্ডে কাজ পেয়েছেন মেসার্স শাহ আমানত ট্রেডিংয়ের মালিক মোস্তফা মো. জাবেদ, ৬ নম্বর পূর্ব ষোলশহর ওয়ার্ডে কাজ পেয়েছেন মেসার্স গাউসিয়া ট্রেডার্সের মালিক শাহজাহান, ২ নম্বর জালালাবাদ ওয়ার্ডে কাজ পেয়েছেন  নগর সেবা প্রতিষ্ঠানের মালিক মো. জিয়া উদ্দীন জাবেদ এবং ৩২ নম্বর আন্দরকিল্লা ওয়ার্ড ও ৪০ নম্বর উত্তর পতেঙ্গা ওয়ার্ডে কাজ পেয়েছেন সাবেক নৌবাহিনী কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন (অব.) মহসিনুল হাবিব।

চসিকের কর্মকর্তারা জানান, দায়িত্ব পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো ১০ খাতে টাকা আদায় করতে পারবে। এর মধ্যে রয়েছে- বাসা-বাড়ির প্রতি ফ্ল্যাট থেকে মাসে ৫০ থেকে ৭০ টাকা ও সেমিপাকা ঘরে ২৫ থেকে ৪০ টাকা। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি মাসে ১০০ থেকে ৫০০ টাকা। শিল্প-কারখানার আয়তন, শ্রমিক সংখ্যা ও উৎপাদিত বর্জ্য অনুপাতে মাসে তিন হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা। হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁর আয়তন ও বর্জ্যের পরিমাণ অনুযায়ী দুই হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা, কমিউনিটি সেন্টার থেকে প্রতি ১০০ জন অতিথির জন্য ২০০ টাকা হারে দিতে হবে।

এই কাজে আমার অভিজ্ঞতা নেই। তবে, আমার সঙ্গে যারা কাজ করবেন তাদের অভিজ্ঞতা আছে। বর্জ্য সংগ্রহে যেসব সরঞ্জাম প্রয়োজন হবে তা সংগ্রহ করছি। আশা করছি শিগগিরই কাজ শুরু করতে পারব হাট-বাজার ও শপিং মলের ইজারাদার ও ব্যবসায়ী সমিতিকে উৎপন্ন বর্জ্যের অনুপাতে মাসে দুই হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা, পুরাতন ভবন সংস্কার ও নতুন ভবন নির্মাণে  সৃষ্ট বর্জ্যের জন্য টন প্রতি এক হাজার টাকা, ভ্রাম্যমাণ দোকানের উৎপন্ন বর্জ্যের পরিমাণ অনুপাতে দৈনিক ২০ থেকে ৫০ টাকা এবং ড্রাম ও ডাস্টবিন সরবরাহের জন্য সবাইকে এককালীন এক হাজার টাকা করে দিতে হবে। বিনিময়ে সিটি কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে ওয়ার্ডের ওপর ভিত্তি করে ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা রাজস্ব আদায় করবে।

চসিকের কর্মকর্তারা জানান, দায়িত্ব পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর অতীত অভিজ্ঞতা নেই। এছাড়া নেই পর্যাপ্ত জনবল, রিকশা-ভ্যান, হাতগাড়ি, ইঞ্জিন ট্রলি ও অন্যান্য সরঞ্জাম। অথচ বাসা-বাড়ি ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে অন্তত ৩৫০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা ব্যবসা করবে দায়িত্ব পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো। এ প্রসঙ্গে কোতোয়ালি থানা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক শাহাদাত হোসেন নাবিল বলেন, ‘এই কাজে আমার অভিজ্ঞতা নেই। তবে, আমার সঙ্গে যারা কাজ করবেন তাদের অভিজ্ঞতা আছে। বর্জ্য সংগ্রহে যেসব সরঞ্জাম প্রয়োজন হবে তা সংগ্রহ করছি। আশা করছি শিগগিরই কাজ শুরু করতে পারব। চট্টগ্রাম করদাতা সুরক্ষা পরিষদের মুখপাত্র হাসান মারুফ রুমী বলেন, ‘আমরা হোল্ডিং ট্যাক্স দিই, তার ৭ শতাংশ ব্যয় হয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য। এখন সিটি কর্পোরেশন নিজেদের জনবল দিয়ে বা কোনো প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে কাজ করাবে, সেটা তাদের বিষয়।

এক্ষেত্রে আবার কেন আমরা টাকা দেব? আর এখন যে প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজ দেওয়া হয়েছে, তারা অনভিজ্ঞ। ময়লা সুষ্ঠুভাবে অপসারণ করা না হলে আমরা ভুক্তভোগী হব। এই প্রক্রিয়া বাতিল করতে হবে। আমরা হোল্ডিং ট্যাক্স দিই, তার ৭ শতাংশ ব্যয় হয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য। এখন সিটি কর্পোরেশন নিজেদের জনবল দিয়ে বা কোনো প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে কাজ করাবে, সেটা তাদের বিষয়। এক্ষেত্রে আবার কেন আমরা টাকা দেব

চসিকের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা কমান্ডার ইখতিয়ার উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘একেকটি বাসা কিংবা প্রতিষ্ঠান একেক দূরত্বে। কোনোটি কাছে, কোনোটি দূরে। সব বাসা-প্রতিষ্ঠান থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এটি কর্পোরেশনের দায়িত্বও না। আইনে আছে সিটি কর্পোরেশন নির্দিষ্ট স্থান থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করবে। এই কারণে বাসা থেকে ময়লা সংগ্রহের জন্য আমরা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দিয়েছি। ‘শুধু আমরা না; ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনও এভাবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দিয়েছে। আমরা তাদের অনুসরণ করেছি।

এক্ষেত্রে কাজ দেওয়ার আগে আমরা প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তাদের ভাইভা নিয়েছি। তাদের শ্রম মন্ত্রণালয়ের লাইসেন্স আছে কি না, দেখেছি। এটি না থাকলে দ্রুত সংগ্রহ করার জন্য বলেছি। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয় সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা দেওয়ার কাজ বন্ধ করতে হবে অথবা কর নেওয়া বাদ দিতে হবে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বর্জ্য সংগ্রহ করলে সিটি কর্পোরেশনের কাজ কী? এই বেআইনি কাজ থেকে চসিককে সরে আসতে হবে।

Link copied!