নোয়াখালীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ায় এক বছর আগে জীবিকার তাগিদে গভীর সমুদ্রে পাড়ি দিয়েছিলেন ১৩ জন জেলে। কিন্তু সেই যাত্রা থেকেই তারা আর ঘরে ফেরেননি। গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর চরঈশ্বর, চরকিং ও সুবর্ণচরের বিভিন্ন গ্রামের এ জেলেরা মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ হন। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও আজও তাদের সন্ধান মেলেনি। স্বজনদের বুকভরা হাহাকার আর শূন্যতার যন্ত্রণা প্রতিদিন নতুন করে গ্রাস করছে পরিবারগুলোকে।
নিখোঁজ ব্যক্তিরা হলেন, চরঈশ্বর ইউনিয়নের তালুকদার গ্রামের নুরুল ইসলামের ছেলে মো. হেলাল উদ্দিন(৪২)। মো. আলাউদ্দিনের ছেলে মো. ছালেহ উদ্দিন(৪৫)। সিরাজুল হকের ছেলে মো. লিটন উদ্দিন(৩৪)। আবদুল কুদ্দুসের ছেলে মো. মিলাদ উদ্দিন(৪৩)। চরকিং ইউনিয়নের চরকৈলাশ গ্রামের মোল্লা বাড়ির মো. মনিরের ছেলে আবদুল মান্নান (৩৮)। মো. কামালের ছেলে মো. জাবের উদ্দিন(৩৬)। মোঃ মাইন উদ্দিনের ছেলে মো. সাইফুল ইসলাম (৩৭)। চরকিং ইউনিয়নের ফরাজী গ্রামের আবুল কাশেমের ছেলে রকিব উদ্দিন(৩৪)। সুবর্ণচর উপজেলার দক্ষিণ চরমজিদ ইউনিয়নের— আনছার মিয়ার হাটের ছেরাজুল হকের ছেলে মো. গোলাম মাওলা(৪১)। চরমজিদ গ্রামের মাইন উদ্দিনের ছেলে মিরাজ উদ্দিন(৩৮)। এ ছাড়া আরও তিনজন জেলে ছিলেন একই নৌকায়, যাদের নাম পরিবারের লোকজন জানালেও আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করা যায়নি।
নিখোঁজের পরপরই কোস্টগার্ড, নৌবাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসন সমুদ্র ও উপকূলজুড়ে অভিযান চালায়। কিন্তু কোনো সন্ধান মেলেনি। নৌকাটিও উদ্ধার হয়নি। ফলে পরিবারগুলো এখনও নিশ্চিত হতে পারেনি প্রিয়জনরা জীবিত না মৃত।
এই বিষয়ে ২২.১০.২০২৪ সালে সাজেদা বেগম বাদি হয়ে মো. মিলন উদ্দিন মাঝি, পিং ইমদাদ, মালেক মাঝি, পিং ফজর আলী, মো. মন্টু সরদার পিং মৃত আবুল হোসেন, নয়ন মাঝি পিং মোজাহার হোসেন, শরিফ মাঝি পিং তোফাজ্জল হোসেন, মো. শাহিন পিং মাকেল মাঝি সহ ৪/৫ অঙ্ঘাতনামা আসামী করে হাতিয়া থানা অভিযোগ করা হয়েছে। যাহার এস ডি আর নং১২৯৯।
ফরাজী গ্রামের রকিবের স্ত্রী রেশমা বেগম কণ্ঠ ভারী করে বলেন, প্রতিদিন মনে হয় স্বামী আজ হয়তো ফিরবে। সন্তানরা বাবার কথা জিজ্ঞেস করে কাঁদে। কিন্তু কোনো উত্তর দিতে পারি না। কিভাবে সংসার চালাবো কোন পথে খুঁজে পাচ্ছি না।
চরঈশ্বর ইউনিয়নের হেলালের মেয়ে শিল্পী বেগম বলেন, প্রতিদিন মনে হয় আমার বাবা আজ হয়তো ফিরবে। মা ও মৃত আমার ছোট ভাই বোন কে নিয়ে সংসার চালাতে খুবই কষ্ট হয়। আমরা জানতে চাই তাহারা কি বেচে না কি মরে গেছে সেটা ও জানতে পারি নাই।
চরকৈলাশ গ্রামের সাজেদা বেগম বলেন, আমার স্বামী ছাড়া আমার সংসার চলে না। এখন সন্তানদের ভরণপোষণ ও খাওয়াতে হিমশিম খাচ্ছি। সরকারের কাছে মিনতি করছি অন্তত নিশ্চিত করে জানানো হোক তারা বেঁচে আছে কি না।
পরিবারগুলোর অভিযোগ প্রথমদিকে প্রশাসন তল্লাশি চালালেও কয়েকদিন পর আর কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। সরকারি সহায়তাও মেলেনি তেমন। ফলে পরিবারগুলো দিশেহারা হয়ে পড়েছে।
চরঈশ্বর ইউনিয়নের মিলাদের স্ত্রী রুনা বেগম বলেন, গত একবছর যাবৎ আমার স্বামী নিখোঁজ রয়েছে। ছেলে মেয়ে সংসার নিয়ে খুব কষ্টে আছি। আমার স্বামীসহ হাতিয়ার নিখোঁজ জেলেদের সন্ধান চাই।
চরঈশ্বর গ্রামের বৃদ্ধ আলা উদ্দিন আবেগে ভেঙে পড়ে বলেন, আমার ছেলে ছালেহ উদ্দিনকে অন্তত একবার দেখতে চাই। যদি বেঁচে থাকে, দোয়া করি ফিরুক। না থাকলে মরদেহটা হলেও চাই।
নিখোঁজ জেলেদের অনেক সন্তান স্কুল ছেড়ে দিয়েছে। কেউ খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছে, কেউ আবার ধারদেনায় জর্জরিত। পুরো গ্রামজুড়ে ভাসছে শূন্যতার হাহাকার।
স্থানীয় সমাজকর্মী আশ্রাফ বলেন, “এটি শুধু ১৩টি পরিবারের নয়, পুরো হাতিয়ার বেদনা। রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছিল অন্তত সত্যটা জানানো। এক বছরেও কোনো তথ্য না পাওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক।”
হাতিয়া উপজেলা সূর্য মুখী মাছ ঘাটের সভাপতি আলা উদ্দিন বলেন, আমরা বহুবার বলেছি, সমুদ্রগামী জেলেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আধুনিক সরঞ্জাম, ট্র্যাকিং সিস্টেম, ঝড়ের আগাম বার্তা এসব ব্যবস্থা না থাকলে এ ধরনের দুর্ঘটনা বারবার ঘটবে। ১৩ জেলের নিখোঁজ হওয়া আমাদের জন্য বড় সতর্কবার্তা।”
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রতিদিন হাজারো জেলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গভীর সমুদ্রে যায়। ঝড়-বৃষ্টি, বৈরী আবহাওয়া, জলদস্যুদের তৎপরতা—সব মিলিয়ে তাদের জীবন অনিশ্চিত। সরকারের নীতি থাকলেও মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন দুর্বল বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
স্বজন ও স্থানীয়দের দাবিগুলো হলো ১। নিখোঁজ জেলেদের খোঁজে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়ানো, ২। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর আর্থিক সহায়তা ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা, ৩ । সমুদ্রগামী জেলেদের জন্য আধুনিক নিরাপত্তা সরঞ্জাম ও ট্র্যাকিং ব্যবস্থা চালু করা, ৪। নিয়মিত অনুসন্ধান কার্যক্রম ও তথ্য প্রকাশে প্রশাসনের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।
আপনার মতামত লিখুন :