আব্দুস সামাদ আজাদ, মৌলভীবাজার: মৌলভীবাজার শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে মোস্তফাপুর ইউনিয়নের গয়ঘর গ্রামে ঢুকলেই দূর থেকে চোখে পড়ে ঝলমলে সাদা রঙের একটি স্থাপনা। উঁচু টিলার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এই মসজিদ যেন পাঁচ শতকেরও বেশি সময়ের সাক্ষ্য বহন করছে। স্থানীয়দের কাছে এটি কেবল একটি নামাজের জায়গা নয়, বরং এক জীবন্ত ইতিহাস গয়ঘর খোজার মসজিদ।
১৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে সুলতান শামস উদ্দিন ইউসুফ শাহের শাসনামলে হাজি আমীরের পৌত্র ও তৎকালীন মন্ত্রী মজলিস আলমের হাত ধরে মসজিদটির যাত্রা শুরু। চুন, সুরকি আর পুরু ইটের গাঁথুনিতে গড়া স্থাপনাটি আজও মুগ্ধ করে ভিজিটরদের। তিনটি বড় দরজা আর ছয়টি ছোট দরজা পার হয়ে ভেতরে ঢুকতেই যেন ছুঁয়ে যায় কয়েকশ বছরের ইতিহাস। পশ্চিম দেয়ালের কৃষ্ণপাথরের শিলালিপি, চুরি ঠেকাতে লোহার খাঁচায় বাঁধা, আর দেয়ালের উপরের দিকে ফুল-লতার কারুকাজ—সব মিলিয়ে এক অপূর্ব শিল্পকীর্তি।
কিন্তু মসজিদের সবচেয়ে চমকপ্রদ গল্প লুকিয়ে আছে পূর্ব দিকের একটি স্তম্ভে। সেখানে আজও স্পষ্ট দেখা যায় বাঘের থাবার চিহ্ন। গ্রামের প্রবীণরা বলেন, মসজিদ যখন গড়ে উঠছিল, চারপাশ ছিল ঘনজঙ্গল আর বাঘের আনাগোনার ভয়। হয়তো সেই সময়ই এক বাঘ মসজিদের কাঁচা দেয়ালে থাবা মেরেছিল। পাঁচশ বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে, তবু সেই তিনটি থাবার দাগ মুছে যায়নি। যেন সময়ের বুকেই আঁচড় কেটে রেখে গেছে সেই বাঘ।
মসজিদের নাম নিয়েও আছে কাহিনি। অনেকে বলেন, মানসিংহের আক্রমণে বিতাড়িত পাঠান বীর খাজা উসমান এখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেই খাজা থেকেই মসজিদের নাম হয়েছে ‘খোজা’। মসজিদের ভেতর ১৮ ফুট উঁচু গম্বুজের ভেতরের গোলাকার অংশে দৃষ্টিনন্দন নকশা, মেঝে ও বারান্দার টালির ঝলক, আর আরবিতে খচিত বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম—সব মিলিয়ে যেন ইতিহাসের সঙ্গে এক আধ্যাত্মিক সৌন্দর্যের মেলবন্ধন।
দক্ষিণ পাশে ছোট্ট পুকুরে গজার মাছের খেলা যেন অন্যরকম প্রাণ যোগায়। সীমানার ভেতর বিশাল ঈদগাহ মাঠে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার জামাতে হাজার হাজার মুসল্লিরা একসঙ্গে নামাজ আদায় করেন। পূর্ব দিকে রয়েছে কবরস্থান, আর প্রবেশের জন্য পূর্ব ও দক্ষিণে দুটি ছোট গেট। বিগত শতকে মসজিদটি বহুবার সংস্কার হয়েছে।
১৯৪০ সালে গম্বুজ ভেঙে গেলে কামেল পীর আজম শাহ মানুষের কাছ থেকে চাঁদা তুলে হবিগঞ্জের বানিয়াচং থেকে ইসমাইল মিস্ত্রির তত্ত্বাবধানে সংস্কার করান। ১৯৬০ সালেও তাঁর হাতেই হয় আরেক দফা সংস্কার। পীর আজম শাহ চলে যাওয়ার পর একসময় মসজিদে জন্মায় বটের চারা, চারপাশে ছেয়ে যায় ঝোপঝাড়। পরে ১৯৬৫-৬৬ সালে পুনরায় সংস্কার হয়, আর ১৯৮৪ সালের সংস্কারে পূর্বদিকে সম্প্রসারণ ও নারীদের জন্য আলাদা বারান্দা যুক্ত করা হয়। যদিও তখন কিছুটা বদলে যায় প্রাচীন স্থাপত্যের আদল।
প্রতিটি জুমার দিনে আজও দেশের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ আসেন এখানে নামাজ আদায় করতে, কিংবা কেবল ইতিহাস ছুঁয়ে দেখতে। স্থানীয়দের স্বপ্ন, ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় খোজার মসজিদের নাম একদিন জায়গা করে নেবে—যাতে এই সাড়ে পাঁচশ বছরের স্থাপত্যের গল্প পরের প্রজন্মও গর্ব করে শুনতে পারে।
আপনার মতামত লিখুন :