দর্শনায় তরুণের উদ্ভাবিত “হেক্সাগার্ড রোভার” মালয়েশিয়ায় স্বর্ণপদক অর্জন

অনলাইন ডেস্ক , প্রতিদিনের কাগজ

প্রকাশিত: ০১ অক্টোবর, ২০২৫, ০২:১৯ পিএম

শিমুল রেজা ,চুয়াডাঙ্গা :  একজন স্বপ্নবাজ তরুণ, যার ছেলেবেলা থেকেই ছিল রোবটের প্রতি কৌতূহল। স্বপ্ন ছিল রোবোটিক্সের মাধ্যমে মানুষের কল্যাণে নতুন কিছু সৃষ্টি করা। চুয়াডাঙ্গার দর্শনার তরুণ জাহিদ হাসান জিহাদের সেই স্বপ্ন এখন বাস্তবে রূপ নিয়েছে। তার উদ্ভাবনী ‘হেক্সাগার্ড রোভার’ দেশের সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসিত হয়েছে।
 
বোমা শনাক্তকরণ ও নিষ্ক্রিয়করণে সহায়তা, অগ্নি শনাক্তকরণ ও নির্বাপন, বন্যপ্রাণী নিয়ন্ত্রণ ও উদ্ধার কার্যক্রম, সীমান্তে নজরদারিসহ বিভিন্ন সামরিক মিশন পরিচালনায় সক্ষম এই রোভার। সম্প্রতি মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে সেগি ইউনিভার্সিটিতে চার দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হয় ওয়ার্ল্ড ইনোভেশন কমপিটিশন অ্যান্ড এক্সিবিশন (WISE) ২০২৫। সেখানে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রায় দুই শতাধিক দল অংশগ্রহণ করে। এই বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় প্রদর্শিত হয় ‘হেক্সাগার্ড রোভার’, যা ব্যাপক প্রশংসিত হয়। জিহাদের উদ্ভাবন বাংলাদেশকে এনে দিয়েছে স্বর্ণপদক।
 
তার সাফল্যে খুশি স্বজন ও এলাকার মানুষ। গত বছর জিহাদের উদ্ভাবনী ‘ট্রেন সিকিউরিটি সিস্টেম’ উপজেলা ও জেলার গণ্ডি পেরিয়ে ব্যাপক সাড়া ফেলে জাতীয় পর্যায়ে। রোবোটিক্স নিয়ে ব্যাপক গবেষণার জন্য দর্শনা সরকারি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী জাহিদ হাসান জিহাদ প্রতিষ্ঠা করেন চুয়াডাঙ্গা সায়েন্স অ্যান্ড রোবোটিক্স ক্লাব। সেখানে প্রায় এক বছর ধরে নিরলস পরিশ্রম করে তৈরি করেন ‘হেক্সাগার্ড রোভার’। তার কাজে সহযোগিতা করেন সহপাঠী ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা।
 
জাহিদ হাসান জিহাদ বলেন, অগ্নিকাণ্ডে উদ্ধার থেকে সামরিক নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এই রোভার। এতে রয়েছে ১৩০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপ সহ্য করার ক্ষমতা, স্টেইনলেস স্টিল বডি, ধোঁয়া ভেদকারী V38 Pro Zero ক্যামেরা ও MQ সিরিজ গ্যাস সেন্সর। ফলে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা যেখানে পৌঁছাতে অক্ষম সেখানে এই রোবট প্রাথমিকভাবে পানি বা ফোম ছিটিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণ এবং আটকে পড়া মানুষকে উদ্ধার করতে সক্ষম হবে। এছাড়া বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ও সামরিক নিরাপত্তায়ও কাজ করবে রোবটটি।
 
৬-ডিওএফ মেকানিক্যাল আর্ম, মেটাল ডিটেকশন এবং সিগন্যাল জ্যামিং সিস্টেমের মাধ্যমে বিপদজনক বিস্ফোরক শনাক্ত ও নিষ্ক্রিয় করতে সক্ষম এই রোভার। শিল্প ও কারখানা নিরাপত্তায়ও এটি কার্যকর হবে। কার্বন মনোক্সাইডসহ বিষাক্ত গ্যাস শনাক্ত, লাইভ ভিডিও স্ট্রিমিং ও জরুরি সরঞ্জাম পৌঁছে দেওয়ার সুবিধা রয়েছে। সুরক্ষিতভাবে বন্য প্রাণীকে ট্রাঙ্কুলাইজার ইনজেকশনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ, কৃষিক্ষেত্রে মাটির আর্দ্রতা, সেচ ও ফসল মনিটরিংয়েও কাজ করতে পারবে এটি। যুদ্ধ বা দুর্যোগ এলাকায় ওষুধ, খাবার, পানি পৌঁছে দেওয়া এবং ভয়েস কমিউনিকেশনের মাধ্যমে মানুষকে আশ্বস্ত করতেও সক্ষম। এছাড়া নাইট ভিশন ক্যামেরা, সেন্সর ও লাইভ ট্র্যাকিং সিস্টেম ব্যবহার করে সীমান্ত বা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নজরদারি করতে পারে। আগামী দিনে হেক্সাগার্ড রোভারে যুক্ত হবে সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি ও দীর্ঘ পরিসরে চলাচলের ক্ষমতা।
 
বর্তমানে দর্শনা পৌরসভার কাস্টমসপাড়ায় বসবাস করেন জিহাদের পরিবার। তার মা নাসিমা খাতুন বলেন, সাধারণ পরিবেশে জন্ম ও বেড়ে ওঠা জিহাদের ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল রোবোটিক্সের মাধ্যমে নতুন কিছু সৃষ্টি করা। নানা বাধা আসলেও হাল ছাড়েনি সে। দেশের ভেতরেও অসাধারণ কিছু সাফল্য অর্জন করেছে জিহাদ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য—৪৬তম জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মেলায় জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে প্রথম স্থান অর্জন, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে আল জাজিরা ইসলামিক সায়েন্স ফেস্ট প্রতিযোগিতায় রানার-আপ, ওয়াইস বাংলাদেশ রাউন্ডে সিলভার মেডেল এবং মর্যাদাপূর্ণ ড্রিমস অব বাংলাদেশ স্পেশাল অ্যাওয়ার্ড।
 
চুয়াডাঙ্গা সায়েন্স অ্যান্ড রোবোটিক্স ক্লাবের সভাপতি শরিফুল আলম মিল্টন বলেন, প্রথমবারের মতো খুলনা বিভাগ থেকে ওয়াইসে অংশগ্রহণ করেই স্বর্ণপদক জিতলো চুয়াডাঙ্গা সায়েন্স অ্যান্ড রোবোটিক্স ক্লাব। টিমের নেতৃত্বে ছিলেন জাহিদ হাসান জিহাদ এবং সহযোগী ছিলেন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী তোহা বিন আসাদ দীপ। জিহাদের উপস্থাপনা বিচারকদের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং শেষ পর্যন্ত আইটি ও রোবোটিক্স ক্যাটাগরিতে শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি হিসেবে স্বর্ণপদক অর্জন করে। এটি চুয়াডাঙ্গা জেলা তথা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় অর্জন।
 
দামুড়হুদা উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজার রাফিজুল ইসলাম বলেন, জিহাদের এই প্রকল্পটি অত্যন্ত আধুনিক। এটি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আরও সমৃদ্ধ হবে। জাতীয়ভাবে কাজে লাগাতে পারলে দেশের কল্যাণ বয়ে আনবে। বিশেষ করে সামরিক ও প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত যুগোপযোগী।
 
দামুড়হুদা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) কে এইচ তাসফিকুর রহমান বলেন, জিহাদ একজন রত্ন। তার উদ্ভাবনী প্রকল্প দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসা কুড়িয়েছে, স্বর্ণপদক এনে দিয়েছে বাংলাদেশে। বিশ্বে আবারও উজ্জ্বল হয়েছে বাংলাদেশের নাম। তার প্রকল্প বর্তমান যুগের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ও আধুনিক।
 
চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম বলেন, জিহাদের এই অর্জনে আমরা সত্যিই আনন্দিত। বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করেছে সে। চুয়াডাঙ্গা সায়েন্স অ্যান্ড রোবোটিক্স ক্লাবের সর্বাত্মক সাফল্য কামনা করি এবং আশা করি ক্লাবটি আরও দূর এগিয়ে যাবে
 
 

Link copied!