কানাডায় বিলাসী জীবন, দেশে লুকানো সম্পদ

রেজাউল করিম রেজা , বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ০৭ ডিসেম্বর, ২০২৫, ০১:০৯ এএম

সুজনগঞ্জের ভাতগাঁও গ্রামের ছেলে সুজিব রঞ্জন দাস সলটু একসময় বাবার মুদির দোকানের পাশে লুঙ্গি সেলাই করে সংসার চালাতেন। পরে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মরহুম আবদুস সামাদ আজাদের আশীর্বাদে রাজনীতির কাছাকাছি আসেন। সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল হুদা মুকুট ও তার ভাই খায়রুল হুদা চপলের ব্যবসায়িক বলয়ে ঢুকে আলোচনায় ওঠেন তিনি।

এরপর শুরু হয় সলটুর চমকপ্রদ উত্থান। শেখ সেলিমের ছেলে শেখ ফাজলে ফাহিমের আশীর্বাদ পেয়ে হাতে যেন ‘আলাদিনের চেরাগ’ জুটে যায়। মাত্র পাঁচ বছরে কয়েকশ কোটি টাকার মালিক হয়ে ওঠেন তিনি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ফটোসেশন করেও আলোচনায় আসেন সলটু। দেশে-বিদেশে দ্রুত বাড়তে থাকে তার অঢেল সম্পদ। টরেন্টোতেই কেনেন ৪টি বিলাসবহুল বাড়ি, যার মূল্য প্রায় শতকোটি টাকা। এছাড়া দুবাইতে রয়েছে ফ্ল্যাট। টরেন্টোতে প্রতিদিন কোটি টাকার জুয়া খেলার অভিযোগও উঠেছে।

কানাডায় ‘অস্বাভাবিক সম্পদ’—এক এক করে বাড়ি কেনার কাহিনি: অনুসন্ধানে দেখা গেছে টরেন্টোর স্কারবোরো এবং মেবোর্ন এলাকাজুড়ে সলটুর স্ত্রী শেলি দাস ও তার নিজের নামে চারটি বাড়ি কেনা হয়েছে। প্রথম বাড়ি: স্কারবোরোর পিত অ্যাভিনিউ—২০১৯ সালে দুই দফায় পরিশোধ করে শেলি দাসের নামে নিবন্ধন।

দ্বিতীয় বাড়ি: মেবোর্ন অ্যাভিনিউ—১৭ লাখ ৫৫ হাজার ডলারে সলটুর নামে রেজিস্ট্রি। তৃতীয় বাড়ি: স্কারবোরোর আরেক প্লট—ডুপ্লেক্স। চতুর্থ বাড়ি: মেবোর্নের ১৯০ নং প্লটের ট্রিপলেক্স—১৩ লাখ ২৫ হাজার ডলারে কেনা। বর্তমানে পরিবার নিয়ে সলটু এখানেই থাকেন।

সবগুলো কেনাকাটায় ‘ইকুইটি ক্রেডিট ইউনিয়ন ইনক’, ‘কানাডা ইনক’, ‘কুবার মর্গেজ ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন’সহ একাধিক কোম্পানির মাধ্যমে টাকা পরিশোধ দেখানো হয়েছে—যা অর্থপাচারের সন্দেহকে আরও ঘনীভূত করছে। বাংলাদেশ থেকে টাকার প্রবাহ—গ্যাস চুরি, টেন্ডারবাজি ও লুটপাট  অনুসন্ধান বলছে—শেখ ফাহিমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুযোগে সলটু শুরু করেন কোটি কোটি টাকার ব্যবসা। সুনামগঞ্জের মল্লিকপুরে গ্যাস পাম্প চালু করেন; যেখানে মিটার লক করে দীর্ঘদিন গ্যাস চুরি করে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা হাতানো হতো। জালালাবাদ গ্যাস কোম্পানির একাধিক অসাধু কর্মকর্তা এ কাজে যুক্ত ছিল।৫ আগস্ট এ পাম্প বন্ধ করা হলেও পরে আবার খুলে দেওয়া হয়।

সিলেট, সুনামগঞ্জ ও ঢাকার ঠিকাদারি কাজে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় কোটি কোটি টাকার টেন্ডার পান সলটু ও তার বন্ধু খায়রুল হুদা চপল। হাওড়ে ফসল তলিয়ে যাওয়ার ঘটনায় দুদকের মামলাতেও তারা প্রধান আসামি ছিলেন। পরে রহস্যজনকভাবে তাদের নাম বাদ দেওয়া হয়—যা দুদকের তদন্তকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

‘টোকাই থেকে টাকার কুমির’—রাজনৈতিক বলয়ের ছত্রছায়ায় উত্থান: স্থানীয়দের ভাষ্য, সলটুর উত্থান বাস্তবতার চেয়ে রূপকথাকে ছাড়িয়ে গেছে। ১৯৯৬ সালে নির্বাচন মাঠে আবদুস সামাদ আজাদের জুতা পরিষ্কার করতেন তিনি। সেখান থেকেই শুরু রাজনীতির করিডোরে প্রবেশ। পরে নুরুল হুদা মুকুটের সাব-ঠিকাদারি, যুবলীগ নেতাদের ক্যাডার বলয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ ফাহিমের ‘ক্যাশিয়ার’ হিসেবে কাজ করতে করতে তিনি হয়ে ওঠেন ‘অদৃশ্য ক্ষমতার’ মালিক।

 

কানাডায় বিলাসী জীবন, দেশে লুকানো সম্পদ: 

সিলেট উত্তর বাগবাড়িতে কয়েক কোটি টাকার বাড়ি, বসুন্ধরায় ফ্ল্যাট, দামি গাড়ি—এসব রেখে সলটু এখন কানাডায় পলাতক জীবন কাটাচ্ছেন। সিলেট থেকে কানাডায় পালানো নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলেন—“সলটুর মতো শত শত লুটেরার কারণেই দল আজ এমন অবস্থায়। এরা হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে।”

বক্তব্য নিতে যোগাযোগের চেষ্টা:  শেখ ফাজলে ফাহিম পলাতক থাকায় তার মন্তব্য পাওয়া যায়নি।সুজিব রঞ্জন দাস সলটু ফোন রিসিভ করলেও পরিচয় জানার পর লাইন কেটে দেন। খুদে বার্তা পাঠানো হলেও কোনো উত্তর দেননি।

Advertisement

Link copied!