শনিবার, ০২ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:০৪ পূর্বাহ্ন
কলিহাসান,দুর্গাপুর(নেত্রকোনা):
নেত্রকোনার দুর্গাপুরের সোমেশ্বরীর বালু এখন এলাকাবাসীর অভিশাপ হয়ে উঠেছে। বালু ব্যবসায়ীদের বালুবাহী ট্রাক বেপরোয়া চলাচলের কারনে যেমন বাড়ছে দুর্ঘটনা তেমনি নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ। পৌর শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা সোমেশ্বরী নদীটি এক সময় ছিল অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনন্য লীলাভূমি। ওই নদীর চরে থাকা বালু সরকারি ইজারায় বিক্রি করা হলেও কোন বাইপাস সড়ক না থাকায় পরিবহনে ঘটছে বিড়ম্বনা সেই সাথে বাড়ছে এলাবাসীর দুর্ভোগ। বাইপাস সড়ক ও বালু পরিবহন নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে নানা সংগঠন আন্দোলন করলেও বালু পরিবহনে বিকল্প রাস্তা নির্মাণের কোন উদ্দ্যোগ নেয়া হচ্ছে না।
গত বুধবার সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, দুর্গাপুর উপজেলার সোমেশ্বরী নদীকে কেন্দ্র করে ১, ২, ৩, ৪ ও ৫নং বালু মহাল প্রায় ১শত কোটি টাকায় বাৎসরিক ইজারা দেয় নেত্রকোণা জেলা প্রশাসন। বালু মহাল গুলো ইজারা নেয়ার পর সরকারি নিয়মনীতি দেখভালে কোন লোক না থাকায় ইজারাগণ ইচ্ছে মতোই উত্তোলন করছে বালু। সেইসাথে উত্তোলিত বালু গুলো ভেজা থাকায় শুকনো মৌসুমেও পৌরশহরের রাস্তাঘাটে কাঁদা জমে থাকে। বালুর পানি অবিরাম সড়কের ওপর পড়ে প্রতিনিয়ত সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতার। এতে স্থানীয় বালু ব্যবসায়িরা ব্যাপকভাবে লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে সোমেশ^রী নদী সৌন্দর্য ও এলাকার সাধারণ মানুষ।
ভেজা বালু পরিবহনে প্রায় ৩শ ১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত দুর্গাপুর-শ্যামগঞ্জ ৩কিলো মহাসড়কের রাস্তা খানা-খন্দে ভরপুর। দুর্গাপুর পৌরসভার বিভিন্ন এলকা সহ বিরিশিরি ও উৎরাইল এলাকার কার্পেটিং সড়কের বিভিন্ন স্থান ভেঙ্গে গিয়ে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। বালু উত্তোলনের কোন সঠিক পরিকল্পনা না থাকার কারণে বিপর্যস্ত হচ্ছে পৌরবাসীর জীবনমান। মুনাফালোভী ওই সম্প্রদায়ের দৌরাত্মের কারণে লরি-ট্রাকগুলোতে অতিরিক্ত বালু বোঝাই থেকে শুরু করে সড়কে চলে অদক্ষ চালকদের টাকা আয় করার অসুস্থ প্রতিযোগিতা।
প্রতিনিয়ত সড়কে ঝড়ছে প্রাণ। সড়ক দুর্ঘটনা এখানে নিত্যদিনের সঙ্গী। বালুবাহী ট্রাকের চাপায় পিষ্ট হয়ে ২০২২ সালের আগষ্ট মাস পর্যন্ত ঝড়ে গেছে শিক্ষার্থীসহ প্রায় শতাধিক প্রাণ। আহত হয়েছেন প্রায় ২শ জনের মতো। এর আগেও আরও ৪ শিশু মাত্র ১৫ দিনের ব্যবধানে দুর্গাপুরের বিভিন্ন স্থানে লড়ি ও ট্রাকের চাপায় মারা যায়। সব মৃত্যুই বেদনাদায়ক, কিন্তু এ ধরনের অপমৃত্যু মেনে নেওয়া অত্যন্ত কঠিন। নিরাপত্তার দাবিতে স্থানীয় এলাকাবাসী বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন করলেও টনক নড়েনি স্থানীয় প্রশাসন ও বালু ব্যবসায়ীদের। সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক নদীর চরের বালু ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে উত্তোলন করে নেয়ার কথা থাকলেও দিনের পর দিন বাংলা ড্রেজার দিয়ে নদী থেকে উত্তোলন করছে বালু ও পাথর। এ যেন জনগনের সাথে চলছে চোর-পুলিশ খেলা। জেনেও না জানার ভান করছে দায়িত্বে থাকা প্রশাসন।
দুর্গাপুরকে স্থানীয়রা একসময় শান্তির জনপথ বলে গর্ববোধ করতো। সেই জনপদে এখন ভয়ের রাজত্ব চলছে। ঘর থেকে বের হলে বালুবাহী ট্রাক-লড়ির চাপায় পিষ্ট হওয়ার ভয়, আবার প্রভাবশালী ঘাতকদের বিরুদ্ধে কথা বললেও বিভিন্নভাবে হুমকি-ধামকি, অত্যাচার, নির্যাতন, লাঞ্চিতের শিকার হওয়ার ভয়, দোকান-পাট বন্ধ করে দেয়ার ভয়। কিছুদিন আগে নিরাপদ সড়কের দাবিতে স্থানীয়দের নিয়ে ‘‘নিরাপদ সড়ক চাই’’ এর আয়োজনে শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ মানববন্ধনে হামলা চালানো হয়েছিলো।
এ সময়ে পর্যটকদের ভিড়ে পৌরশহরের দোকান গুলোতে আদিবাসী পোষাক কেনার ভিড় লেগে থাকত। কিন্তু বর্তমানে রাস্তা-ঘাটে কাঁদা থাকার কারণে দুর্গাপুর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন ভ্রমণ পিপাসুরা। শহরের দোকান গুলোয় ক্রেতাশূন্য অবস্থায় বসে থাকতে দেখা যায় প্রায়সময়ই। জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাগণ বালু পরিবহনের জন্য বাইপাস সড়ক নির্মাণের আশ্বাস দিলেও এখন পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন হয়নি। অথচ প্রতি বছর দুর্গাপুরের বালু মহাল থেকে শত কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হলেও বাইপাস সড়ক নির্মাণে জেলা প্রশাসন কোন উদ্দ্যোগ নিচ্ছেন না।
সীমান্তবর্তী গারো পাহাড়ের কোল ঘেঁষা দুর্গাপুর ও সোমেশ্বরী নদী দেশের জাতীয় সম্পদ। পর্যটনশিল্পে অপার সম্ভাবনাময় এমন সম্পদ ইচ্ছেমত সিন্ডিকেটের হাতে ছেড়ে দেয়া যায় না। দুর্গাপুরের সাধারণ মানুষ ও সোমেশ্বরী নদীর দুর্দশা নিরসনে যথাযথ কর্তৃপক্ষ সহ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন এলাকাবাসী।
এ নিয়ে পৌর মেয়র মো. আলা উদ্দিন জানান, পৌরশহরের ওপর দিয়ে ভেজাবালু পরিবহন সত্যিই বিরক্তি কর। এ বছরও আমি প্রায় ৫ কোটি টাকা ব্যায়ে শহরের ভঙ্গুর রাস্তা গুলো মেরামত করিয়েছি। ২০২১ সনের মে মাসের ২০ তারিখ বাইপাস সড়ক নির্মাণের জন্য নেত্রকোনা জেলা প্রশাসক কাজী আব্দুর রহমান,পাউবো নেত্রকোনা‘র নির্বাহী প্রকৌশলী এম এল সৈকত, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী বিশ্বজিৎ কুমার কুন্ডু, উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ রাজীব-উল-আহসান, সহকারী কমিশনার (ভুমি),উপজেলা প্রকৌশলী, পৌর প্রকৌশলীগণ এলাকা পরিদর্শন শেষে পরিকল্পনা হাতে নেয়ার পরও বাইপাস সড়ক নির্মাণের কার্যক্রম কেনো থেমে আছে তা জানিনা। ইতোমধ্যে পৌরসভার পক্ষ থেকে পুণরায় জেলা প্রশাসনের সমন্বয় সভায় এ ব্যাপারে দাবী জানানো হয়েছে। নতুন করে এলাকা পরিদর্শন শেষে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসন।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা(ইউএনও) মোহাম্মদ রাজীব উল আহসান বলেন, ভেজাবালু বন্ধে মোবাইল কোর্ট অভিযান অব্যাহত আছে। জেলা প্রশাসন থেকে প্রায়ই মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে। ভেজা বালু পরিবহন বন্ধে একা প্রশাসনের পক্ষে যতটা সম্ভম,ততটা সহযোগিতা দরকার ইজারাদার ও ট্রাক মালিক ও শ্রমিকদের। তাহলে এ অবস্থার খুব দ্রæতই পরিত্রাণ সম্ভব বলে মনে করেণ তিনি।