শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০১:২৬ পূর্বাহ্ন
গুঁড়া হলুদের মাধ্যমে একজন অন্তঃসত্ত্বা নারীর শরীরে প্রবেশ করছে বিষাক্ত সিসা, আর তা থেকেই অনাগত শিশুর শরীরে প্রবেশ করছে এই হেভি মেটাল। গবেষণার তথ্য বলছে, ২ থেকে ৪ বছরের শিশুদের শতভাগই সিসা বয়ে বেড়াচ্ছে। ঢাকার ৫০০ শিশুর নমুনা পরীক্ষা করে সবার রক্তেই এই ধাতবটি পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে ৮০ ভাগ শিশুরই শরীরে নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি সীসা আছে। ইউনিসেফের উদ্যোগে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর, আন্তর্জাতিক উদারময় গবেষণা কেন্দ্র আইসিডিডিআর-বি সম্প্রতি এই গবেষণা পরিচালনা করে।
গবেষকরা জানান, একজন অন্তঃসত্ত্বা নারী যখন সিসাযুক্ত হলুদ খাবারের মাধ্যমে গ্রহণ করেন, তখন তা রক্তের মাধ্যমে শিশুর শরীরে পৌঁছে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, অন্তঃসত্ত্বা নারীর রক্তে সিসার উপস্থিতি আসে মূলত গুঁড়া হলুদ থেকে। সিসা দ্বারা দূষিত হলুদের গুঁড়া অন্তঃসত্ত্বা নারীর শরীরে উচ্চ মাত্রার সিসার উপস্থিতির কারণ। পল্লী এলাকায় পরীক্ষা করা ৩০ শতাংশ অন্তঃসত্ত্বা নারীর শরীরে সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
বাজারে বিভিন্ন পণ্য পরীক্ষা করেছে আইসিডিডিআর-বি। পরীক্ষায় ৩৬৭টি পণ্যের মধ্যে ৯৬টি পণ্যে সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। চারটি শহরে স্থানীয়ভাবে তৈরি খেলনা, রঙ, অ্যালুমিনিয়াম ও সিলভারের হাঁড়ি পাতিল, সবজি, চাল এবং মসলার নমুনায় সিসার উপস্থিতি পাওয়া যায়। চারটি শহরের মধ্যে আছে— ঢাকা, বরিশাল, রাজশাহী ও খুলনা। এছাড়া মাটি, ছাই, পোড়া মাটি ও হলুদের গুঁড়ায় সিসার পাওয়া গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, ‘বিভিন্ন হেভি মেটাল আমাদের শরীরে নানা ধরনের মেটাবলিক অ্যাক্টিভিটি করে। কিন্তু সিসা এমন একটি হেভি মেটাল, যেটা আমাদের শরীরে কোনও মেটাবলিক অ্যাক্টিভিটি করে না। তাহলে কোন মাত্রা সহনীয় এবং সেটি কীভাবে নির্ধারণ করা যাবে? এজন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সিসার ক্ষেত্রে কোনও মাত্রা দেয় না। যখন কোনও মাত্রা দেওয়া হবে না, তার মানে যেকোনও মাত্রাই ক্ষতিকর। তারপরও আমরা যদি সিডিসি’র মাত্রা ধরে নেই, আমাদের রিস্ক ফেক্টর হচ্ছে— সব মাত্রাই অনেক বেশি।’
তিনি বলেন, ‘অল্প বয়সের শিশুদের জন্য বিষয়টি ভয়ঙ্কর। কারণ, তাদের যেকোনও কিছু মুখে দেওয়ার প্রবণতা থাকে। প্লাস্টিকের রঙ, খেলনা কিংবা অন্য কিছু হোক, শিশুরা মুখে দেবেই। অ্যালুমিনিয়ামের পাত্রে রান্না হয়, পানির যে পাইপ সেখানেও সিসা আছে। কিছু গবেষণা আছে, যেখানে দেখা গেছে— পানির সোর্সে, যেখানে ধারণ করা হচ্ছে, ওই জায়গাতেও সিসা পাওয়া যাচ্ছে। সমস্যা হচ্ছে আগে এ নিয়ে স্টাডি হয়নি। শিশুদের ব্রেইন ডেভেলপমেন্ট হচ্ছে না, অ্যাগ্রেসিভ হয়ে যাচ্ছে। শিশুদের ক্ষেত্রে প্রধান উৎস কিন্তু খাবার।’
বাংলাদেশের সাড়ে তিন কোটির বেশি শিশু ক্ষতিকারক সিসা শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছে। বড়দের তুলনায় শিশুদের শরীরে এই ধাতবের প্রভাব বেশি। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের চারটি জেলার শিশুদের রক্তে সিসার উপস্থিতি এবং তার মধ্যে ৬৫ শতাংশের রক্তে সিসার পরিমাণ যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি’র নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি।’
গবেষণা তথ্য বলছে, টাঙ্গাইল, খুলনা, সিলেট, পটুয়াখালী— এই চার জেলায় পরীক্ষা করা হয়েছে। এই চার জেলার পরীক্ষিত ৯৮০ শিশুর সবারই রক্তে সিসার উপস্থিতি মিলেছে। এর মধ্যে ৬৫ শতাংশ শিশুরই রক্তে সিসার মাত্রা যুক্তরাষ্টের সিডিসি নির্ধারিত মাত্রা ৩ দশমিক ৫ মাইক্রো গ্রামের বেশি। এর মধ্যে ২৪ মাস থেকে ৪৮ মাস বয়সী শিশুদের শতভাগের শরীরেই সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ একটি গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে। তাতে বাজার থেকে উজ্জ্বল রঙয়ের গুঁড়া হলুদ কিনতে নিষেধ করা হয়। কারণ, তাতে কৃত্রিম রঙ দেওয়া থাকে। কৃত্রিম রঙ ছাড়া হলুদ কিনে নিজেরা গুঁড়া করে এবং বেটে ব্যবহার করার পরামর্শ দেয় প্রতিষ্ঠানটি। এরপর ২০১৯ সালে সরকার লেড ক্রোমেট আমদানি সীমিত করে দেওয়ার ঘোষণা দেয়। সরকারের হস্তক্ষেপের কারণে ২০১৯ সালের আগে গুঁড়া হলুদে ২ দশমিক ৫ মাইক্রোগ্রামের বেশি সিসার উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছিল ২০ শতাংশ নমুনায়। এরপর ২০২০ সালের জানুয়ারিতে তা কমে দাঁড়ায় ৬ শতাংশে। একই বছরের সেপ্টেম্বরে তা আরও কমে দাঁড়ায় ৩ শতাংশে। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে তা দাঁড়ায় দশমিক ৫২ শতাংশে।
চিকিৎসকরা বলছেন, ছোটবেলা থেকেই সিসার প্রভাব শিশুদের বুদ্ধিমত্তা কমায়, মনোযোগের ঘাটতি তৈরি করে। এর প্রভাবে শিশুরা লেখাপড়ায় দুর্বল হয়, যা ভবিষ্যতে অনেক আগ্রাসী করে তোলে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস অ্যান্ড গাইনি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক বেগম নাসরীন বলেন, ‘অন্তঃসত্ত্বা থাকা অবস্থায় শিশু মায়ের সঙ্গে প্লাসেন্টা দিয়ে আটকে থাকে। প্লাসেন্টার আরেকটি অংশ জরায়ুর সঙ্গে যুক্ত থাকে। এই প্লাসেন্টার মাধ্যমেই শিশুর কাছে খাবার ও অক্সিজেন পৌঁছায়। যে কারণে আমরা ওষুধ দিলেও অনেক সতর্কতার সঙ্গে দেই। শিশুর জন্য ক্ষতি করতে পারে, এমন ওষুধ আমরা দেই না। কারণ, প্লাসেন্টা দিয়ে শিশুর কাছে যেতে পারে। এজন্য শিশুর কথা চিন্তা করেই নিরাপদ ওষুধ দেই। কারও শরীরে যদি হেভি মেটাল থাকে, সেটি প্লাসেন্টা দিয়েই শিশুর শরীরে প্রবেশ করবে। বিশেষ করে প্রথম তিন মাসে শিশুর হাত, পা, নাক, কান, চোখ তৈরি হয়। সেই সময় যদি কোনও বিষাক্ত জিনিস কিংবা হেভি মেটাল মায়ের শরীরে থাকে, সেটা শিশুর জন্য ক্ষতিকারক।’