নোয়াখালী দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার ৭ লাখ লোকের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যাওয়া আসার মূল প্রবেশদ্বার হলো চেয়ারম্যান ঘাট। আবার এই ঘাটের পাশে গড়ে উঠেছে দক্ষিণ অঞ্চলের সব চেয়ে বড় মাছের বাজার। মাছ বাজারের পাশে বিশাল সিএনজি স্টেশন এ ঘাটকে আরো ব্যস্তময় করে তুলেছে। যার ফলে ৫ আগস্ট পরবর্তী দখল পাল্টা দখল ইজারা নেওয়া শক্তি প্রদর্শন জোর পূর্বক মাছ বিক্রি করা সব কিছুতে এগিয়ে দোলন-জুয়েল সিন্ডিকেট। এসব অভিযোগ স্বয়ং বিএনপি দলীয় নেতা কর্মীদের।
ইলিয়াছ হোসেন ইসমাইল হাতিয়া উপজেলা যুবদলের আহবায়ক হলেও সে একজন মৎস্য ব্যবসায়ী। সে অনেক পূর্বে থেকেই মাছের ব্যবসার সাথে জড়িত রয়েছে। সম্প্রতি এ সিন্ডিকেট তার ট্রলারের মাছ জোরপূর্বক বিক্রির অভিযোগ উঠেছে।
জানা যায়, এ মাছ ঘাট নিয়ন্ত্রণে ১৩ জনের একটি সম্মিলিত সমন্বয়ক কমিটি গঠন করা হয়। যেখানে হরণী ইউনিয়ন বিএনপি’র সভাপতি আক্তারুজ্জামান দোলন, সাধারন সম্পাদক এহসানুল হক জুয়েল সহ দলীয় ১৩ জন সবাই সমমানের পদে রয়েছেন। এছাড়াও ঘাট নিয়ন্ত্রণে বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের ৪০ জন সদস্য রয়েছেন।যারা ফ্যাসিস্ট আমলের সুবিধাভোগী ব্যবসায়ীরা আত্মগোপনে থাকায় তাদের ডাকের বাক্স ও গদি দখল করে বর্তমানে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। এ নিয়ে ঘাটে প্রায় সময় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে হট্টগোল লেগে থাকে।
গত সোমবার (২২ এপ্রিল) মুজাম্মেল হাজী নামে এক বোট মালিক চেয়ারম্যানঘাটের দাদন ব্যবসায়ী ও যুবদল নেতা ইসমাইলের গদিতে মাছ দিতে গেলে এক দল সন্ত্রাসী বাধা দেয় এবং তারা ওই মাছ অন্য গদিতে নিয়ে বিক্রি করে দেয়।
দোলন, জুয়েল ও ইমাম হাসানের নেতৃত্বে স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহবায়ক নিজাম উদ্দিন, সদস্য মাইনউদ্দিন, নাহিদ ও সালাউদ্দিন এবং নোয়াখালী কলেজ ছাত্রদলের সহ-সভাপতি শরীফ, হরনী ইউনিয়ন ছাত্রদলের সভাপতি সাদ্দাম, সর্বদলীয় সন্ত্রাসী জামশেদ উদ্দিন জেমিসহ বেশ কয়েকজনের একটি গ্রুপ এসে নৌকা থেকে মাছ ছিনিয়ে নিয়ে যায়।
ভুক্তভোগী মুজাম্মেল হাজী জানান, আমি ব্যবসায়ী ইসমাইলের কাছ থেকে ৪ লাখ টাকা দাদন নিয়েছি। সে কারণে তার গদিতে মাছ দেওয়ার জন্য গেলে কয়েকজন লোক এসে আমার মাছগুলো জোরপূর্বক তাদের দখলকৃত ডাকের বাক্সে তুলে বিক্রি করে দেয়। এসময় আমি দাদনের শর্ত অনুসারে ইসমাইলের গদিতে মাছ দিতে হবে বলে অনুরোধ করলেও তারা আমার কথায় কোন কর্ণপাত করেনি।
ইসমাইল হোসেন ইলিয়াস জানান, হাতিয়া চেয়ারম্যান ঘাটটি এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় পাইকারি মাছের বাজার। সম্প্রতি এই বাজারটি দখল করে সাধারন ব্যবসায়ীদের মাছ বিক্রি করে কমিশন ভাগিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে এখানে। এ জন্য বিএনপি নেতা দোলন, ইমাম হাসান ও জুয়েলের নেতৃত্বে ৫১ জনের সিন্ডিকেট তৈরি করা হয়েছে। এদের অনেকে মাছ ব্যবসার সাথে জড়িত নয় কিন্তু তারা এখন মাছ বাজার নিয়ন্ত্রন করছেন। আমি উপজেলা যুবদলের আহবায়ক। অথচ তারা তার দাদন দেওয়া ট্রলারের মাছ জোরপূর্বক নিয়ে বিক্রি করে দেন। প্রায় ১৭ লাখ টাকা মাছ বিক্রির কমিশনও ভাগিয়ে নেন তারা।
ইসমাইল আরো জানান, মাছ বাজার নিয়ে তাদের এই অপকর্মের বিষয়ে বিএনপির জেলা ও বিভাগীয় নেতৃবৃন্দকে বলা হয়েছে।
এ ব্যাপারে অভিযুক্ত ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আক্তারুজ্জামান দোলনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি মাছ বিক্রির বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, আমি জেলেদেরকে ইসমাইলের গদির মাছ বিক্রি করতে নিষেধ করেছি তবুও তারা বিক্রি করে ফেলেছে। এতে যে কমিশন এসেছে তা ইসমাইলকে ফেরত দিতে বলে বিষয়টি মীমাংসা করে দিয়েছি। ঘাট নিয়ন্ত্রণের ৪০ জনের কমিটিতে আমি নেই, ১৩ সদস্যের সম্মিলিত সমন্বয়ক কমিটিতে আছি। এছাড়া যাত্রী পারাপারের ঘাট তার নিয়ন্ত্রণে থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি।
চেয়ারম্যান ঘাট ইজারাদারের প্রতিনিধি ফাহিম উদ্দিন জানান, ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে ইজারাদারের অনুপস্থিতিতে চেয়ারম্যানঘাটের যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের টোল ও ভাড়ার অর্থ আদায় হচ্ছে। সেই অর্থ চেয়ারম্যানঘাট বাজার কমিটির সভাপতির হাত হয়ে ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি দোলনের কাছে জমা হতো। বিগত ৭-৮ মাস আমরা ঘাট থেকে কোন টাকা পয়সা পাইনি।
এদিকে চেয়ারম্যান ঘাটে সীট্রাক, স্পীড বোট ও ট্রলারে যাত্রী ও মালামাল পারাপারেও এ সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য রয়েছে বলে জানা যায়। সীট্রাকের টিকিট বিক্রিতে হস্তক্ষেপ, নির্ধারিত সময়ের আগে কম যাত্রী নিয়ে সীট্রাক ছাড়তে বাধ্য করা হচ্ছে। ট্রলার ও স্পীডবোটে ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রী পারাপারের মাধ্যমে এ ঘাটের নিয়ন্ত্রণ করছে ১৩ সদস্যের সম্মিলিত সমন্বয়ক কমিটি। এ বিষয়ে উপজেলা প্রশাসন ও কোস্টগার্ডের এক বৈঠকে উপজেলা নির্বাহী অফিসার সীট্রাকের ইজারাদারকে সীট্রাকের সিডিউল ও টিকেট বিক্রি এবং ঘাটের ইজারাদারকে ঘাটের যাবতীয় বিষয় দেখাশুনা করার নির্দেশনা দিলেও সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে তা উপেক্ষিত হয়ে আসছে।
সম্প্রতি হাতিয়া উপজেলা প্রশাসন হাতিয়ার ৩৯টি হাটবাজার ইজারা দেয় যার মধ্যে চেয়ারম্যানঘাট একটি। এ সিন্ডিকেট সুকৌশলে চেয়ারম্যানঘাট বাজারের ইজারা নিয়ে জেলা সদর সহ বিভিন্ন উপজেলা থেকে আসা সিএনজি, বাস-মিনিবাস, প্রাইভেট কার ও ট্রাক থেকে রিসিটের মাধ্যমে টোল আদায় করছে বলে জানা যায়। স্থানীয়রা জানায় ইতোপূর্বে চেয়ারম্যানঘাট বাজারের কোন ইজারাদার টোল বা চাঁদা আদায় করেনি।
এ বিষয়ে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এর হাতিয়া উপজেলা উত্তর শাখা এক লিখিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে অভিযোগ করে জানায়, চেয়ারম্যানঘাট বাজারের ইজারাদার রিয়াজ সব ধরণের যানবাহন ও পরিবহন থেকে টোলের নামে চাঁদা আদায় করছে। এর ফলে স্থানীয় ব্যবসায়ী ও সাধারণ যাত্রীদের অতিরিক্ত ভাড়া দিতে হচ্ছে। টোলের ভয়ে এখন এদিকে যাত্রীবাহী গাড়ীর পরিমাণ কমে যাওয়ায় জনসাধারণ চরম ভোগান্তিতে রয়েছে।
এই বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী শামীম বলেন, চেয়ারম্যান ঘাট বাজারে আসা ট্রাক, সিএনজি সহ বিভিন্ন যাত্রী পরিবহন থেকে অবৈধভাবে টোল আদায়ের বিষয়ে অভিযোগ পেয়েছি। আমরা এ বিষয়ে চেয়ারম্যান ঘাট বাজারের ইজারাদারকে সতর্ক করেছি। এছাড়া উপজেলা পরিষদ থেকে ইজারা দেওয়া প্রত্যেক বাজারের ইজারাদারদের অবৈধ টোল আদায় বন্ধে চিঠি ইস্যু করেছি। এসব অনিয়মের বিষয়ে উপজেলা এবং জেলা বিএনপির অবগত রয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক নেতা কর্মী জানান, এ সকল অনিয়মের কারণে তাদেরকে জেলাতে ঢেকে নিয়ে ভৎসনা করা হয়েছে। তাতেও কোন পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়নি।
এ বিষয়ে উপজেলা বিএনপির সভাপতি একেএম ফজলুল হক খোকন বলেন, দলের নাম ভাঙ্গিয়ে যারা চাঁদাবাজি বা দলবাজি করবে তাদের বিরুদ্ধে দল কঠিন সিদ্ধান্ত নেবে। আমাদের বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশ যারা দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করবে তাদেকে ছাড় দেওয়া হবেনা।
আপনার মতামত লিখুন :