নামে রুপা হলেও প্রতিভায় নিখাঁদ স্বর্ণ, সখীপুরের রুপা আক্তার

ইলিয়াস কাশেম , সখীপুর (টাঙ্গাইল) সংবাদদাতা

প্রকাশিত: ২০ আগস্ট, ২০২৫, ০৫:৪২ পিএম

ছবি- প্রতিদিনের কাগজ

টাঙ্গাইলের সখীপুর পৌর শহরের জিরো পয়েন্ট থেকে মাত্র  ২ কিলোমিটার পূর্বে সখিপুর সরকারি কলেজ (সাবেক মুজিব কলেজ)  থেকে পূর্ব পাশে মাত্র আধা কিলোমিটার দূরত্বে জাতীয় নারী ফুটবল দলের মধ্য মাঠ দাপিয়ে বেড়ানো রুপা আক্তারের বাড়ি।

রুপার বাবা রহিমুদ্দীন পেশায় একজন দরিদ্র ভ্যান চালক। রুপা আক্তার কাদের নগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় তৎকালীন স্বৈরশাসকের বঙ্গমাতা নামক ফুটবল টুর্নামেন্ট খেলায় দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখিয়ে নজরে আসে জেলা ক্রীড়া সংস্থার পরিচালক কামরুন্নাহারের। তারপর আর রুপা আক্তারকে পিছনে তাকাতে হয়নি। ৪ ভাই বোনের ২য় রুপা আক্তার  ভর্তি হয়ে যান বিকেএসপিতে। রুপা এবার দশম শ্রেণিতে অধ্যায়নরত একজন মেধাবী ছাত্রী, ২০২৬ ব্যাচের এসএসসি পরীক্ষার্থী। লেখা পড়ার পাশাপাশি সে তার অদম্য আগ্রহে জাতীয়  নারী ফুটবল দলের একজন গর্বিত খেলোয়াড় হিসেবে খ্যাতি অর্জন করতে অনেকটাই সফল। দারিদ্রতার কষাঘাতে বাঁধাগ্রস্থ করতে পারেনি রুপার দুর্দান্ত প্রতিভাকে, সেই সাথে সামাজিক বাধ্য বাধকতা কিংবা লোকমুখের কটুকথা বা সমালোচনাও তাকে আটকে রাখতে পারেনি।  আর তাইতো রুপা এখন বাবা-মা ও পরিবারের সকলের অনুপ্রেরণায় মাত্র সতেরো বছর বয়সে এসেই জাতীয় নারী ফুটবল দলের একজন মধ্যমনি হতে সক্ষমতা অর্জন করে বিস্ময় করে দিয়েছেন তার জন্মস্থান সখীপুরসহ পুরো টাঙ্গাইল জেলা তথা বাংলাদেশকে। 

রুপার বাবা রহিমুদ্দীন জানান, বড় মেয়ে রত্নাও ফুটবলার ছিলেন। রুপার মতো ছোট মেয়ে আফরিনও ভালো ফুটবল খেলে। মূলতঃ রুপা তার বড় বোন রত্নার ফুটবল খেলা দেখেই উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা পান সূচনাতে। কিন্তু দরিদ্র পরিবারের সন্তান হওয়াতে টানাটানির সংসারে অল্প বয়সেই রত্নার বিয়ে দিতে হয় তার দরিদ্র বাবা-মাকে। আর বিয়ের পর থেকেই রুপার প্রেরণার উৎস তার বড় বোন রত্না  সংসার জীবনে জড়িয়ে ছিটকে পড়েন এই ফুটবল খেলার জগৎ থেকে। কিন্তু রুপা দমে যায়নি, সে তার অদম্য ইচ্ছা শক্তির বলে আপন মনে নির্বিঘ্নে চলতে থাকেন এই পথটি ধরেই।  রুপা ২০২২ ইংরেজি সনে বিকেএসপির মাধ্যমে পদযাত্রা, ২০২৩ সনে ভারতে আন্ডার ১৭ সুব্রত কাপে অংশ নেন। ২০২৪ সনে জাতীয় দলের জন্য অনুশীলন শুরু করেন। 

চলতি ২০২৫ সনের মার্চ মাসে জাতীয় দলের হয়ে সাফ গেমস্ ও এএফসিতে চ্যাম্পিয়ন ট্রফি অর্জন করেন। রুপার আশা ২০২৬ সনের নারী বিশ্বকাপে বিশ্বের বুকে নিজেকে মেলে ধরবেন। রুপা তার পরিবার ও ভাইবোন নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেন। আপাতত তার তেমন কোন চাওয়া নেই। শুধু মাত্র তার বাড়ির পাশ দিয়ে চলে যাওয়া পাকা রাস্তাটি থেকে তার নিজ বাড়ি পর্যন্ত বেশ কিছু পরিবারের চলাচলের অযোগ্য মাত্র কোয়াটার কিলোমিটার কাঁচা রাস্তাটিকে মেরামতসহ পাকাকরণ করতে স্থানীয় প্রশাসনের নিকট বিশেষ অনুরোধ জানান রুপার বাবা। আর এ দাবি শুধু রুপার পরিবারের একার নয়, প্রতিবেশী সবার চলাচলের স্বার্থেই। ফুটবল খেলার জগতে পদার্পন যাত্রার শুরুতেই এলাকার সকলের সহযোগিতা পেয়েছেন রুপা, আবার কেউ কেউ নারী হিসেবে ভিন্ন চোখেও দেখেছেন।  রুপার  স্বপ্ন দেশের হয়ে কিছু করবার। রুপার সাথে কথা বলতে গিয়ে তার চোখে দেশপ্রেমের এক গভীর ও সুচারু দৃষ্টি লক্ষ্যণীয় হয়ে জ্বল জ্বল করতে দেখা গেছে, রুপার এই সফলতা অর্জনে আমরা "দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ" পরিবারের পক্ষ থেকেও জানাই অফুরন্ত অভিনন্দন। 

রুপাদের  বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়,একটি মাত্র  টিনের ঘর, মেঝে কাঁচা, আর এই একটি মাত্র ঘরেই পরিবারের সকলকে নিয়ে বসবাস রুপাদের। পৌর শহরের পূর্ব বর্ডার এলাকায় এক নির্জন অজেয়পাড়া গাঁয়ে রুপার জন্ম। আজ রুপা শুধু যেন রুপা নয়, সে সখিপুরের এই নির্জন অন্ধকার গ্রামটিতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, সখীপুরসহ গোটা টাঙ্গাইল বাসীর গর্বের ধন, এবং বাংলাদেশের একজন রুপালী স্বর্ণ।  রুপা এক সপ্তাহের ছুটিতে এসে বাড়ির উঠোনে ফুটবলের অনুশীলন করছে।

পশু-পাখির লালন পালন করে অবসর সময় কাটাচ্ছেন।  তার দুই কাজল কালো টানা চোখে, এখন শুধুই নারী ফুটবল বিশ্বকাপের বিজয়ী ট্রফির এক নিগুঢ় স্বপ্ন।

Link copied!