ফতুল্লা ডিপোর গ্রেজার টুটুল, মালিক শত কোটি টাকার

অনলাইন ডেস্ক , প্রতিদিনের কাগজ

প্রকাশিত: ১২ অক্টোবর, ২০২৫, ০৮:০৭ পিএম

যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা ডিপোতে সম্প্রতি পৌনে চার কোটি টাকার ডিজেল গায়েব হয়েছে । এই ঘটনার সাথে জড়িত অনেকেই, তবে সরাসরি জড়িত থাকার  অভিযোগ উঠেছে ডিপোর গ্রেজার পদে কর্মরত জয়নাল আবেদীন টুটুলের বিরুদ্ধে । ফতুল্লা ডিপোতে  গ্রেজার পদ তিনটি , কিন্তু  দায়িত্ব পালন করছে টুটুল একাই। শুন্য গ্রেজার পদ দুটোতে  অন্য  কেউ পোষ্টিং হয়ে আসুক এটা চায়না তেল টুটুল,  হয়েছেও তাই। বিগত সতের বছর ধরে তিনি একাই  তিনটি গ্রেজার পদ দখল করে রেখেছে। ডিপোর সকল তেল পরিমাপ সে একাই করে। অবশ্য তেল মাপার সময় নিজে উপস্থিত থাকেনা। তারই পছন্দের ক্যাজুয়েল শ্রমিক দিয়ে তেলের পরিমাপ করা হয় । যমুনা অয়েল এবং বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনে ( বিপিসি)  টুটুলের আছে অনেক ক্ষমতা।

  প্রতিষ্টানটিতে তিনি এতই ক্ষমতাধর তেল চুরির সিন্ডিকেট নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে  শুধু ফতুল্লা ডিপোতে ক্যাজুয়েল পদে চাকরি দিয়েছে তার ২৯ আত্মীয়কে। এদের তালিকায় আছে  তার ভগ্নিপতি আমির মিটারম্যান,  শ্যালক রিপন গ্রেজার,  ভাগিনা অন্তর গ্রেজার, শ্যালকের ছেলে হাসান  গ্রেজার,  শ্যালকের মেয়ের জামাই রবিন গ্রেজার,  ফুফাতো ভাই মিলন মিটারম্যান, শ্যালকের ছেলে স্বপন  অফিস সহকারী, বন্ধুর ভাই রাজীব মিটারম্যান,  বন্ধু অমল গ্রেজার,  ভাগ্নে জামাই লিকন পাম্প অপারেটর, বন্ধু রোকন সিলম্যান,  তার বাড়ীতে আছে একাধিক কেয়ারটেকার, এদের প্রত্যকের ছেলেকে  সিকিউরিটি পদে চাকরি দেয় ,এদের তালিকায় আছে  নুরুল ইসলাম, ,ফরহাদ, ফরিদ ও রহামান৷ এছাড়া একই পদে চাকরী দিয়েছে তার বাড়ীর কাজের বেটির দুই ছেলে  জুয়েল ও  সুমনকে।

এছাড়া চাকরীর তালিকায় আরো আছে মায়ের বান্ধবীর ছেলে আরমান  টিবয়, মায়ের আরেক বান্ধবীর ছেলে হাবিব  মিটারম্যান,  বড় বোনের দেবর খালেক পরিচছন্ন কর্মী,  তার লীডার সিবিএ নেতা  মুহাম্মদ এয়াকুবের ভগ্নিপতি ফারুক  মিটারম্যান, বন্ধুর ভাই  শিহাব গোডাউন ইনচার্জ,  বন্ধুর ভাই শামীম  গ্রেজার, বাড়ির  ইলেকট্রিশিয়ান বেলাল  ইলেক্ট্রিশিয়ান, বন্ধুর ভাই ফাহিম  মিটার ম্যান।  ক্যান্টিনে কাজ করছে আরও তিন আত্মীয়৷ এদের  সকলেই  ক্যাজুয়েলে চাকরী করছে তবে ভগ্নপতি হারুন মিটারম্যান স্থায়ী পদে চাকরী করে৷ মুলত এদের দ্বারাই টুটুল  নিয়ন্ত্রন করছে ফতুল্লা ডিপোর চোরাই সিন্ডিকেট৷ অবশ্য স্থানীয় ভাবে তেল মাফিয়া হিসেবে তার ব্যাপক পরিচিত।

বিশেষ করে ফতুল্লাবাসী তাকে তেল টুটুল হিসাবেই চিনেন।  চাকরি জীবন শুরু ২০০১ সালে অস্থায়ী ভিত্তিতে ( নো ওয়ার্ক নো পে) পদ ডিপোর ক্যান্টিন বয়। কাজ ছিল ক্যান্টিনের প্লেট ধোয়া। দৈনিক হাজিরা ৫০ থেকে ৫৫ টাকা । ২০০৫ সালে তার চাকরি স্থায়ী হয় । তবে এবার কৌশলে পদ পদবি পরিবর্তন করে তেল মাপার গ্রেজার পদে পদায়ন করা হয়। শুরু হয় ভাগ্যের পরিবর্তন। জড়িয়ে যায় তেল চুরির সিন্ডিকেট সদস্যদের সাথে । পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে ওসমান পরিবারের সদস্য আজমেরি ওসমানের ক্ষমতার দাপটে, বাগিয়ে নিয়েছিল যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যকরী সভাপতি পদটিও।

প্রতিষ্ঠানটিতে গড়ে তুলেছে একচ্ছত্র আধিপত্য।  জিম্মি হয়ে যায় পুরো ফতুল্লা ডিপো। তার কথার বাইরে কিছুই হয়নি এই ডিপোতে । সাবেক এমপি শামীম ওসমানের ভাতিজা আজমেরী ওসমানের প্রকাশ্য ছত্রছায়ায় তেল চুরির মহা সিন্ডিকেট গড়ে তুলে তেল মাফিয়া জয়নাল আবেদীন টুটুলের নেতৃত্বে। অভিযোগ রয়েছে আজমেরী ওসমানের অর্থের যোগানদাতাও ছিল এই টুটুল । ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে আজমেরী ওসমানের সকল দলীয় কর্মসুচীতে লোকবলের যোগানও দিয়েছে সে। 

প্রকাশ্যে করেছে আওয়ামীলীগের রাজনীতি। ফতুল্লায় দলীয় যেকোন প্রোগ্রামের অগ্রভাগে দেখা যেতো শ্রমিকলীগ নেতা টুটুলকে। তেল পাচারের জন্য টুটুলের মালিকধানী আছে নিজস্ব একটি অয়েল ট্যাংকার, যেটা দিয়ে চোরাই তেল পাঁচার করা হয়। নিয়ম বহিভুত ভাবে তার মালিকানাধীন অটি নসিহত নামে ওয়েল ট্যাংকারটি যমুনা ওয়েলে চাটারভুক্ত করা হয়েছে।  আছে তেলের জাহাজও। 

অনুসন্ধানে জানা গেছে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী জয়নাল আবেদীন টুটুলের বেতনের বেতন সর্বসাকুল্যে ২৫ হাজার ৪৬২ টাকা। অথচ এই চাকরি জীবনে মালিক হয়েছে বাড়ি, দামী গাড়ি , সহায় সম্পত্তি ব্যাংক ব্যালেন্স সহ  অনেক কিছুর। ফতুল্লার লালপুরে ব্রাজিল  বাড়ি হিসাবে পরিচিত ছয়তলা ভবনটির মালিক এই টুটুল । ডুপ্ললেক্স অত্যাধুনিক এই বাড়ীটি নির্মাণ করে  ২০১৪ । যার বর্তমান বাজার মুল্য প্রায় দশ কোটি টাকা । বাড়ি নির্মাণের সময় চতুর টুটুল দশ বছর মেয়াদি বিশ লাখ টাকা  লোন নিয়েছিল তবে শোধ করে দিয়েছে মাত্র দেড় বছরের মাথায় ।

খোজ নিয়ে জানা গেছে ২০১৪ সালের ২৩ মার্চ নারায়ণগঞ্জ ইউসিবি ব্যাংক থেকে এই লোনটি নেয় এবং তা পরিশোধ করেছে ২০১৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর । দশ কোটি  টাকার বাড়ি নির্মাণে লোন মাত্র বিশ লাখ টাকা তাও আবার দেড় বছরের মাথায় পরিশোধ। এটাকেই টুটুল প্রচার করছে ব্যাংকের লোনে বিলাশ বহুল বাড়ীটি নির্মাণ করেছে । ঠিক এই বাড়ীটির সন্নিকটে কিনেছে আট শতক জমি , এছাড়া ফতুল্লার পিলকুনি মোজায় আছে  আরও চার শতক জমি। নিজে ব্যবহার করছে একটা টয়োটা প্রিমিও কার যার নাম্বার ঢাকা মেট্রো গ - ৩৯৮৫৩৯, গাড়ীটির কাগজ পত্র রেজিষ্ট্রেশন তার প্রথম স্ত্রী মাহিনুরের  নামে ।

এছাড়া নামে, বেনামে কিংবা আত্মীয় স্বজনদের নামে কিনে রেখেছে শত কোটি টাকার সম্পত্তি ।  বসুন্ধরার রুপায়ন ডেভলপারে আছে টুটুলের ১৮০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট । নারায়ণগঞ্জ চাষার মোড়ে রিলায়েন্স ডেভলপার থেকে কিনেছে দুটো ফ্ল্যাট, ফ্ল্যাট নাম্বার তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় ২৬১ ও ২৫৯/বি । একটি বালির জাহাজ ছাড়াও কেরানীগন্জ কাঠাইল নদীর পাড়ের একটি  ডক ইয়ার্ডের মালিকও টুটুল।  লালপুর এলাকায় তার বোন উষা আক্তারের নামে জমি কিনে ডুপ্লেক্স বাড়ি নির্মাণ করেছে । জমিটির খতিয়ান নং সিএস ৭৩ এস এ ৬০ আরএস ১২, নামজারী জমাভাড় ৯৫২ নং খতিয়ান ভুক্ত ।

যার জোত নং ৯৫১। একই এলাকায় খানকা শরিফের লাগোয়া পুর্বপাশে বোনের নামে কিনেছে আরও  দশ শতক জমি যার দাগ নং সিএস ও এসএ ৫০ আর এস ৯০। একই দাগে একই বিক্রেতা মনির হোসেন সর্দারের ভাই হানিফ সর্দারের কাছ থেকে খানকা শরিফের উত্তর পাশে ভায়রার ছেলে হাসানের নামে কিনে রেখেছে আরেকটি প্লট।  জয়নাল আবেদীন টুটুলের প্রথম স্ত্রী মাহিনুর আক্তারের নামে পানগাও কেরানীগঞ্জে আছে ১৮ কাঠা জমি  । ইউএস বাংলায় আছে দুটো প্লট। ফতুল্লার রুপালি ব্যাংক, সোসাল ইসলামি ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া এবং চাষারার ডাচ বাংলা ব্যাংক, ইউসিবিএল ব্যাংকে নিজ, স্ত্রী তার বোনের নামে একাউন্টে আছে কোটি কোটি টাকা ।

 টুটুলের যমুনা অয়েলে আগমন তার বাবার মৃত্যুর পরপরই । নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলার আবদুল্লাহপুর গ্রামের মৃত রফিক মিয়ার ছেলে জয়নাল আবেদীন টুটুল ।  বাবা রফিক ছিল ফতুল্লা ডিপোর সিকিউরিটি গার্ড । কর্তব্যরত অবস্থায় মারা যায় তার পিতা রফিক। মারা যাওয়ার সদস্য হিসাবে প্রতিষ্ঠানটি কাজ পায় এই টুটুল।  ওসমান পরিবারের ঘনিষ্ঠ হিসাবে পরিচিত জয়নাল আবেদীন টুটুল জুলাই আগষ্ট ছাত্র জনতার আন্দোলনের বিপরীতে অগ্রভাগে ছিলেন । ২০২৪ সালের ১৯ জুলাইয়ের আগে ফতুল্লা থেকে চাষারায় অস্ত্রের বড় চালান এসেছিল, সেটার যোগানদাতার অভিযোগ উঠেছে এই টুটুলের বিরুদ্ধে । ছাত্র জনতার আন্দোলনে ১৯ জুলাই ২০২৪ নয়ামাটি এলাকায় বাড়ির ছাদে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে রিয়া গুপ। অভিযোগ আছে  টুটুলের অস্ত্রের গুলিতে সে মারা গেছে । 

২০০৫ সালে ৫ আগষ্ট সরকার পরিবর্তনের জনতার রোষানালে পরে জয়নাল আবেদীন টুটুল । স্থানীয় জনতা হামলা চালায় টুটুলের ব্রাজালিয়ান বাড়িতে। ভাংচুর চালানো হয় সেই বাড়িতে, আগুন ধরিয়ে দেয়া তার দুটো গাড়ীতে। একাধিক সুত্রে জানা গেছে তার বাড়িতে রাখা গচ্ছিত দশ কোটি টাকারও বেশি  লুটপাটের খবরটি।  সে যাত্রায় এলাকায় থেকে পালিয়ে রক্ষা পেয়েছে টুটুল । তবে ইতিমধ্যে  স্থানীয় বিএনপির প্রভাবশালী কতিপয় নেতাদের ম্যানেজ করে ফেলেছে সে।  জানা গেছে নারায়ণগঞ্জের আলোচিত বিএনপির এক নেতা ও সেই নেতার স্ত্রীকে পৃথক পৃথক  দুটো গাড়ি উপহার দিয়েছে। এতে ধামা চাপা পড়ে গেছে টুটুলের অতীত সব অপকর্ম। ছাত্র জনতাকে হত্যার অভিযোগে যাত্রাবাড়ী ও সিদ্বিরগন্জ, ফতুল্লা থানায় তিনটি  হত্যা মামলার এজাহার ভুক্ত আসামি জয়নাল আবেদীন টুটুল ।

তবে ধরে ছোয়ার বাহিরে থেকে যাচ্ছে সে। বিগত এক বছর দুই মাস ধরে অফিস করেনা কিন্তু নিয়মিত হাজিরা খাতায় ঠিকই  স্বাক্ষর চলছে টুটুলের। তবে ৪ অক্টোবর পুজোর বন্ধের দিন এবং ৬ অক্টোবর ফতুল্লা ডিপোতে গিয়েছিল তেল টুটুল । ডিজেল গায়েব হওয়ার বিষয়ে তদন্তে এসেছিল ৬ অক্টোবর । তদন্ত কমিটির সামনে হাজির হতে সেদিন ডিপোর পিছনে দিয়ে স্প্রিড বোর্ডে টুটুল ডিপোতে এসেছে, তবে থাকেনি বেশি সময় ।এদিকে একাধিক সুত্রে জানা গেছে যমুনা অয়েল কর্তপক্ষকে ফতুল্লার ডিজেল কেলেংকারী ঘটনায়, তেল টুটুলকে সাময়িক বরখাস্ত করার মৌখিক প্রস্তাব দিয়েছিল বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের এক শীর্ষ কর্মকর্তা। তবে তা যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের এমডি মুস্তফা কুদরুত ই ইলাহি বিষয়টি আমলে নেয়নি। তেল টুটুলের সাথে যমুনা অয়েলের অধিকাংশ  উর্ধতন কর্মকর্তাদের সাথে লেনদেনের সম্পর্ক দীর্ঘ দিনের। 

 তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলে এই ঘটনায় ফেসে যেতে পারে অনেকেই৷ তাই ওকে রক্ষা করতে মরিয়া যমুনা অয়েলের উর্ধতন কর্মকর্তাদের অনেকেই৷ যমুনা অয়েলের দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তার আশংকা তেল টুটুলকে সাময়িক বরখাস্ত করা না হলে এই ঘটনার সঠিক তদন্তে বাধাগ্রস্ত হবে। পাশাপাশি এতবড় ঘটনার পরেও টুটুলকে কেন  বরখাস্ত করা হচ্ছেনা, এই প্রশ্নও তুলেছে অনেকে ।  এবিষয়ে টুটুলের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে তার ব্যবহৃত দুটো মোবাইলেই বন্ধ পাওয়া যায়৷ হোয়াটসঅ্যাপে ক্ষুদে বার্তা হলেও তিনি দেখেছেন, তবে উত্তর দেয় নি ৷

Link copied!