ভালুকায় ১৬ বছরে কার কত টাকার সাম্রাজ্য!

রেজাউল করিম রেজা , বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ১৬ অক্টোবর, ২০২৫, ১২:৫৫ এএম

ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলা ছিল একসময়ের শান্তিপ্রিয় অঞ্চল, যেখানে কৃষি ও ক্ষুদ্র ব্যবসা ছিল স্থানীয় অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। কিন্তু গত ১৬ বছরে আ’লীগের সময়কালে রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ক্ষমতার অপব্যবহার ও অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে এ অঞ্চলটি পরিণত হয়েছে কোটিপতিদের স্বর্গরাজ্যে।

স্থানীয় সূত্র এবং একটি গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, এই সময়ে সাবেক এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌর মেয়র, ভাইস চেয়ারম্যান ও রাজনৈতিক নেতাসহ কমপক্ষে ১৩ জন উপার্জন করেছেন হাজার হাজার কোটি টাকা। সম্পদের উৎসের মধ্যে রয়েছে মাছের খামার, ফিডমিল, জুট ব্যবসা, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি,  আলিশান বাড়ি ও গাড়ি। 

অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, এই সম্পদের বৃহৎ অংশ রাজনৈতিক প্রভাব ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে অর্জিত। সরকারি নথি, স্থানীয় অভিযোগ ও গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে বলা হচ্ছে দুদক এবং স্থানীয় প্রশাসন এই সম্পদ বৃদ্ধির দিকে কার্যকর নজরদারি করতে বিগত দিনে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে ক্ষমতাশালীরা বাধাহীনভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য, ভূমি দখল, টেন্ডার বাণিজ্য ও শিল্প কারখানায় চাঁদাবাজিতে সক্রিয় থেকেছে। ভালুকার রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতা ও অর্থের দ্বন্দ্বের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। উপজেলার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতারা সাধারণ মানুষকে পিছনে ফেলে নিজস্ব ব্যবসা ও সম্পদ বৃদ্ধি করেছেন। 

সূত্র বলছে, উপজেলায় টেন্ডার, জমি বরাদ্দ, মাছের ফিসারী ও ফিডমিল স্থাপনার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাব এত প্রবল, যে সাধারণ মানুষ বা উদ্যোক্তা ওই জায়গায় ব্যবসা শুরু করতে সাহস পান না। এই ক্ষমতার দাপটে গড়ে উঠেছে এক ধরনের ‘সম্পদ সিন্ডিকেট’, যেখানে শুধুমাত্র নির্বাচিত ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা অংশগ্রহণ করতে পারেন।

গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী ভালুকা পৌরসভার সাবেক মেয়র ডাঃ একে এম মেজবাহ উদ্দিন’র পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত জমি ৪ একর, নিজের ক্রয়কৃত জমি ২ একরসহ মোট সম্পদের পরিমাণ আনুমানিক ৩০ কোটি টাকা। মেয়র হিসেবে দায়িত্বকালীন সময়ে টেন্ডার বরাদ্দ ও সরকারি প্রকল্প নিয়ন্ত্রণ তার সম্পদ বৃদ্ধির প্রধান উৎস বলে স্থানীয়রা দাবি করেন। মেয়রের সময়কালেই কয়েকটি সরকারি প্রকল্পে তার পরিবারের ব্যবসা যুক্ত হয়েছে। মেয়র ও পরিবারের নামে কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছে এই সময়কালে।

ভালুকা উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মাহমুদা সুলতানা মুন্নি, তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা মফিজুর রহমানের মেয়ে। তার আধাপাকা বাড়ির ১/৪ অংশ (পৈত্রিক সূত্র) মাছের ফিসারী ও ফিডমিলসহ মোট আনুমানিক সম্পদ ৩০ কোটি টাকা। উপজেলা প্রশাসনের ও স্থানীয় ব্যবসায়িক নেটওয়ার্কে তার প্রভাবমূলক অবস্থান সম্পদ বৃদ্ধির গুরুত্বপূর্ণ কারণ। উপজেলায় ভাইস চেয়ারম্যান থাকাকালীন সময়ে সরকারি জমি ও বরাদ্দ প্রক্রিয়ায় তার পরিবারের অংশগ্রহণ বাড়ে। গোপন নথির ইঙ্গিত -সরকারি নথি অনুযায়ী, মাছের ফিসারী ও স্থাবর ব্যবসায় কিছু বরাদ্দ রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে গড়েছেন।

ভালুকা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মোঃ আবুল কালাম, তার মাছের ফিসারী, ফিডমিল, জুট ব্যবসা, ১৪.৫৫৫ একর + ১২.৫১ একর জমিসহ মোট অনুমান ২৫০ কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন। উপজেলা চেয়ারম্যানের পদে দায়িত্বকালীন সময়ে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে ব্যবসা সম্প্রসারণে সুবিধা পান বলে গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যে উঠে আসে। চট্টগ্রাম-ঢাকা মহাসড়কের প্রকল্পে জুট মিল ও ফিডমিল বাণিজ্য প্রসারিত হয়েছে তার সময়কালেই। কিছু সরকারি বরাদ্দের উন্নয়নের কাজ না করে শত শত কোটি টাকা দুর্নীতি করেছেন।

ময়মনসিংহ-১১ ভালুকা আসনের সাবেক এমপি কাজিম উদ্দিন আহম্মেদ ধনু, তার পিতা মেজর অবঃ আফসার উদ্দিন আহম্মেদ। নগদ ৩০ কোটি টাকা, তিন তলা বাড়ি ও ঘর, ২০ লাখ টাকা প্রাইভেটকার, স্বর্ণালংকার ১১০ ভরি, মাছের ফিসারী, ফিড মিল, জুট ব্যবসা সব মিলিয়ে আনুমানিক ৩০০ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। এমপি হওয়ার পর টেন্ডার বাণিজ্য ও সরকারি প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ করে এ অবৈধ সম্পদ করেছেন। তার সম্পদ বৃদ্ধিতে রাজনৈতিক প্রভাব অস্বচ্ছভাবে ব্যবহার হয়েছে। উপজেলায় রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে দখল বাণিজ্য, অর্থনীতির উত্থান, জনসেবার নামে ব্যক্তি পরিবারের সম্পদবৃদ্ধি। জনগণের প্রশ্ন উন্নয়ন গেল কোথায়? টাকা গেল কার পকেটে?

ভালুকা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক আলহাজ গোলাম মোস্তফা। তিনি রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে জুট ব্যবসা, জমি ক্রয়-বিক্রয়, ফিসারির ব্যবসা, বাংলো বাড়িসহ আনুমানিক ২৫০ কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন। ভালুকা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান হাজী রফিকুল ইসলামের ১২০ কোটি টাকার সম্পদের তথ্য পায় গোয়েন্দা সংস্থা। উপজেলা  চেয়ারম্যান থাকাকালীন সরকারি বরাদ্দ ও ব্যবসায়িক সুযোগ ব্যবহার করে তিনি এ সম্পদ অর্জন করেছেন। ভালুকা উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মোঃ রফিকুল ইসলাম পিন্ট’র রয়েছে মাছের ফিসারী, ফিডমিলসহ আনুমানিক ১০০ কোটি টাকার সম্পত্তি। উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান এজাদুল হক পারুল আনুমানিক ১০০ কোটি টাকার সম্পদের মালিক। মনিরা সুলতানা মনি’র গুলশানে বাড়িসহ আনুমানিক ৮০ কোটি টাকার মালিক। সেলিনা আক্তার (সেলিনা রশিদ), স্থাবর/অস্থাবর সম্পত্তি ২০০ কোটি টাকা। মজিবর রহমান (উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান) আনুমানিক ২০০ কোটি টাকার মালিক। ময়মনসিংহ-১১ ভালুকা আসনের সাবেক এমপি মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াহেদ। দেশে বিদেশে স্থাবর/অস্থাবর মিলিয়ে প্রায় ২৫শ’ কোটি টাকার মালিক। 

ইতোমধ্যে একটি গোয়েন্দা সংস্থার তালিকায় ভালুকার ১৬ বছরের অনিয়ম দুর্নীতি, রাজনৈতিক প্রভাব ও ক্ষমতার অপব্যবহার স্থানীয় নেতাকর্মীদের সম্পদের হিসাব তুলে ধরেন। এ তালিকাটি গোয়েন্দা সংস্থা দুদক ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেছে বলে জানা গেছে। উল্লেখিত সকলেই পলাতক থাকায় তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

ময়মনসিংহ জেলার ১৩ উপজেলা ধারাবাহিক অনুসন্ধানি পর্ব-০১ । 

 

Link copied!