নোয়াখালীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা হাতিয়া। বঙ্গোপসাগরের বুকে ভাসমান এক অনন্য ভূখণ্ড—রাজনীতিতেও যার অবস্থান অনন্য। একসময় হাতিয়া ছিল বিএনপির অন্যতম দুর্গ। কিন্তু সময়ের স্রোতে দলীয় নেতৃত্বে এসেছে ভাঙন, অন্তর্দ্বন্দ্ব, এবং একাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তির উত্থান। এখন প্রশ্ন একটাই—কে পাচ্ছেন নোয়াখালী-৬ (হাতিয়া) আসনে বিএনপির মনোনয়ন?
স্থানীয়রা বলছেন দ্বীপ হাতিয়ার রাজনীতি এখন চরম প্রতিযোগিতার মুখে। অভিজ্ঞতার ভার, তৃণমূলের আস্থা, কেন্দ্রীয় সংযোগ, সব মিলিয়ে নোয়াখালী-৬ আসনে মনোনয়ন যুদ্ধ এখন উত্তপ্ত পর্যায়ে। প্রশ্নটা এখন কেবল সময়ের— কে পাবেন হাতিয়ার মনোনয়নের ‘শেষ হাসি’?
জানা যায়, মনোনয়ন প্রত্যাশীদের তালিকায় এখন আলোচিত পাঁচ নাম: সাবেক সংসদ সদস্য প্রকৌশলী মোহাম্মদ ফজলুল আজিম, বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীম, সর্বাধিক কারানির্যাতত দ্বীপ বন্ধু হিসেবে পরিচিত যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক শিল্প বিষয়ক সম্পাদক কারিমুল হাই নাঈম, হাতিয়া উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী তানভীর উদ্দিন রাজিব, এক সময়ের রাজপথ কাঁপানো কেন্দ্রীয় ছাত্রদল নেতা শাহনেওয়াজ, এই পাঁচজনের রাজনৈতিক অবস্থান, মাঠ পর্যায়ের প্রভাব ও কেন্দ্রীয় যোগাযোগ এখন হাতিয়ার রাজনীতিকে উত্তপ্ত করে তুলেছে।
ফজলুল আজিম: অভিজ্ঞতার ঝাণ্ডাবাহী, দীর্ঘদিনের সংসদ সদস্য থাকায় স্থানীয় রাজনীতিতে তাঁর প্রভাব এখনও টিকে আছে। তবে পারিবারিক সুত্রে জানা গেছে তিনি শারীরিক ভাবে সুস্থ নয়, ঠিক মতো চলাফেরা ও করতে পারেন না। স্থানীয় পুরনো কর্মীরা তাঁকে ‘পরীক্ষিত মুখ’ বলে মানছেন।
তবে তরুণ প্রজন্মের বিশাল একাংশ প্রতিদিনের কাগজকে বলছে—“সময় বদলেছে, নেতৃত্বও বদলাতে হবে।”
মাহবুবের রহমান শামীম: সংগঠন থেকে জনতার ময়দানে, চট্টগ্রাম বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে শামীম মাঠ পর্যায়ে শক্ত অবস্থান গড়ে তুলেছেন। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সম্প্রতি হাতিয়ায় ব্যাপক সাড়া ফেলেছেন। স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন—
“শামীম এখন শুধু সাংগঠনিক মুখ নন, তিনি জনগণের রাজনীতি ফিরিয়ে আনছেন।”
চায়ের দোকানদার আমির হোসেন প্রতিদিনের কাগজকে বলেন, শামীম ভাইয়ের কথা আর কাজ আলাদা নয়। উনি মাঠে নামলে হাতিয়ার মানুষ দল ভুলে উনাকেই ভোট দিবে।
স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতা সুব্রত দাস প্রতিদিনের কাগজকে বলেন, যে নেতা মন্দিরে এসে আশীর্বাদ চায় না, বরং সম্মান দেয়-তাকে মানুষ ভুলবে না।
কারিমুল হাই নাঈম: সংগঠক থেকে জনপ্রিয় মুখে, সর্বোচ্চ সংখ্যক মামলা হামলা, জেল হাজত, প্রথম সারির বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সাথে কারাবরণ, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের আস্থা ভাজন হয়ে উঠা যুবদলের সাবেক কেন্দ্রীয় শিল্প বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে নাঈম দলের মধ্যে প্রভাবশালী। কারীমুল হাই নাঈম, বর্তমানে বিজিএমইএ মার্কেট ডেভেলপমেন্ট বিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান। ব্যবসায়ী শ্রেণির সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক এবং তরুণদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা তাঁকে মনোনয়ন দৌড়ে এগিয়ে রেখেছে। এই মধ্যে তাকে বিএনপির একটা অংশ দ্বীপ বন্ধু হিসেবে ও আখ্যায়িত করছে।
নেতাকর্মীদের একটা অংশ প্রতিদিনের কাগজকে বলছেন, নাঈম বিএনপির দুঃসময়ের কারানির্যাতিত নেতা, কোন ধরনের চাঁদাবাজি, জোর জুলম, করার কোন রেকর্ড নেই হাতিয়ার ছেলে হাতিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলের সব কিছুই চেনেন। গ্রামের রাস্তা ঘাট, নদীভাঙন সবকিছু জানেন। আমরা চাই ওনার মতো তরুণরা নেতা মনোনয়ন নিয়ে আসুক।
প্রকৌশলী তানভীর উদ্দিন রাজিব: তৃণমূলের একটা অংশের আস্থার প্রতীক উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক হিসেবে রাজিব দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় রাজনীতিতে সক্রিয়। সাম্প্রতি সময় তিনি হাতিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে জনগণের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন, তুলে ধরছেন উন্নয়ন ভাবনা। তরুণ ভোটার বলছেন, রাজিব ভাই এমন একজন মানুষ, যিনি প্রতিশ্রুতি নয়—প্রয়াসে বিশ্বাসী।
ছাত্র মিলন চৌধুরী প্রতিদিনের কাগজকে বলেন, হাতিয়ার রাজনীতি এখন বদলে যাচ্ছে। পুরনো মুখ নয়—জনগণের চেনা মুখ রাজীব ভাইকেই এবার দরকার।
শাহনেওয়াজ: ছাত্র দলের কেন্দ্রীয় নেতা রাজপথের লড়াকু সৈনিক, ছাত্রদল থেকে উঠে আসা এই নেতা বিএনপির দুঃসময়ের আন্দোলনে ছিলেন সামনের সারিতে। রাজপথে তাঁর সাহসিকতা ও নেতৃত্বের অভিজ্ঞতা তাঁকে এখনো আলাদা করে রেখেছে।
শাহনেওয়াজকে নিয়ে জানতে চাইলে একজন তরুণ নেতাদের একটা অংশ প্রতিদিনের কাগজকে বলেন, বিএনপি যদি হাতিয়ায় তরুণ নেতা শাহনেওয়াজের নেতৃত্বে ভরসা রাখে, তাহলে ভোটের মাঠে নতুন জোয়ার দেখা যাবে।
বিএনপির একাধিক সূত্রে জানা গেছে, কেন্দ্রীয় পর্যায়ে এখনো হাতিয়া আসনের মনোনয়ন নিয়ে আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে মাঠ পর্যায়ে সংগঠন ও জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের কাজ চলছে। এক কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, হাতিয়া এখন আমাদের জন্য কৌশলগত আসন। যিনি জনগণের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সংযুক্ত, জনগণ যাকে জয়যুক্ত করতে এগিয়ে রাখবে, মনোনয়ন তাঁর দিকেই ঝুঁকবে।
স্থানীয় এক জেলে রফিক উল্লাহ প্রতিদিনের কাগজকে বলেন, আমরা এখন এমন কাউকে চাই, যিনি হাতিয়ার উন্নয়ন বুঝবেন, ঢাকায় বসে রাজনীতি নয়।
স্থানীয় শিক্ষক মহলের একটা অংশ প্রতিদিনের কাগজকে বলছেন, শামীম বা রাজিব—যেই হোক, মাঠে সাধারণ মানুষের পাশে থাকতে হবে তবেই নেতা। এক কথায় তারা জানান সংসদ সদস্য হিসেবে যিনি আসেন না কেন হাতিয়ার উন্নয়নের কোন বিকল্প কিছু থাকতে পারবে না।
ইউনিয়ন পর্যায়ের কর্মীরা বলছেন, আসনটা কার হবে তা বড় বিষয় নয়, বিএনপি ঐক্যবদ্ধ হলে হাতিয়া ঘুরে দাঁড়াবে।
তারা আরো বলছেন কোন গ্রুপিং নয় একটা ঐক্যবদ্ধ বিএনপি চায় তারা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আরো মনে করছেন—এই আসনে মনোনয়ন নির্ধারণের আগে সংগঠন, মাঠের উপস্থিতি ও গ্রহণযোগ্যতা তিনটি বিষয়ই মূল নির্ধারক হবে। যিনি এই তিনটিতে ভারসাম্য রাখবেন, তিনিই শেষ পর্যন্ত হবেন হাতিয়ার ‘মনোনয়ন বিজয়ী’।
আপনার মতামত লিখুন :