ওবায়দুল কাদেরের পুরনো নেটওয়ার্কেই চলছে সওজ

বিশেষ প্রতিনিধি , প্রতিদিনের কাগজ

প্রকাশিত: ৩০ অক্টোবর, ২০২৫, ১২:০১ পিএম

৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও সড়ক ভবনে কার্যত পরিবর্তন আসেনি। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, সওজে এখনো তিনস্তরবিশিষ্ট একটি সিন্ডিকেট সক্রিয়—বদলি-বাণিজ্য সিন্ডিকেট, অর্থপাচার সিন্ডিকেট, রাজনৈতিক পুনর্বাসন সিন্ডিকেট।

এর নেতৃত্বে রয়েছেন বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মঈনুল হাসান, যিনি শেখ পরিবারের ঘনিষ্ঠ ‘বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদ’-এর সক্রিয় সদস্য। প্রধান প্রকৌশলী মঈনুল হাসান সংস্কারের নামে আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তাদের ফের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসাচ্ছেন। তার নির্দেশে ৫ আগস্টের পর একাধিক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে অন্তত ৩০ জন আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তা বিদেশে পাঠানো হয় ‘প্রশিক্ষণ’-এর নামে। অভিযোগ রয়েছে, এর মাধ্যমে ওবায়দুল কাদের ও শেখ পরিবারের অর্থ বিদেশে পাচার করা হয়।

‘মামাভাগ্নে জোন’ ও বদলি বাণিজ্যের সিন্ডিকেট: মঈনুলের ভাগ্নে সহকারী প্রকৌশলী সৈয়দ মুনতাসির হাফিজ ছিলেন বদলি–পদায়ন বাণিজ্যের মূল কারিগর। মুনতাসিরের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার লেনদেন হতো পদায়ন ও ওএসডি আদেশের বিনিময়ে। এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন মো. আমানউল্লাহ, মনিরুল আলম (ডিপ্লোমা সমিতির সাবেক সম্পাদক), যাদের যৌথ দৌরাত্ম্যে ঢাকা সড়ক জোন পরিণত হয় ‘মামাভাগ্নে জোনে’।

তথ্য অনুযায়ী, ৫ আগস্টের আগে মহাখালী সেতু ভবনসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় অগ্নিসংযোগের ঘটনায়ও ‘কাদের চক্র’ সক্রিয় ছিল। অভিযোগ রয়েছে, ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশে ছাত্রলীগ–যুবলীগের একাংশের মাধ্যমে এসব ঘটনা ঘটানো হয়, যাতে সরকারের পতনের আগে বিরোধীদের আন্দোলন প্রশ্নবিদ্ধ করা যায়। অর্থায়নের দায়িত্বে ছিলেন প্রধান প্রকৌশলী মঈনুল হাসান।

মঈনুল নিজের সরকারি বাসভবনে ঠিকাদারের কাছ থেকে ২.৫ কোটি টাকার আসবাব ও ইন্টেরিয়র কাজ করান কোনো টেন্ডার ছাড়াই। পুরস্কার হিসেবে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার আহাদ উল্লাহকে সুনামগঞ্জে পদায়ন দেওয়া হয়। একইভাবে রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা ও প্রোটোকল প্রদানের বিনিময়ে একাধিক নির্বাহী প্রকৌশলীকেও পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।

সাবেক প্রধান প্রকৌশলী কারাগারে, সহযোগীরা বহাল: দুদকের তথ্য অনুযায়ী, সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মনির পাঠান দুর্নীতির মামলায় কারাবন্দি হলেও, তার অর্থ সংগ্রাহক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ ওরফে ম্যাক আজাদ এখনো বহাল তবিয়তে আছেন। দুদকের নোটিশ উপেক্ষা করেও তিনি তদন্ত এড়িয়েছেন— ওবায়দুল কাদেরের প্রভাব ব্যবহার করে।

খুলনা থেকে ঢাকায় ‘অর্থপাচারকারী’ কর্মকর্তা: অভিযোগ রয়েছে, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ আসলাম আলী খুলনা থেকে ঢাকায় পদায়ন পেয়ে এখন রাজধানীর বাইপাস প্রকল্পে প্রভাবশালী অবস্থানে। তিনি একসময় শেখ হেলাল ও শেখ তন্ময়ের অবৈধ অর্থ ভারতে পাচারে সহযোগিতা করেছেন।

৫ আগস্টের পর ৩০ কর্মকর্তাকে বিদেশ পাঠানো হয় প্রশিক্ষণের নামে, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল আওয়ামী আমলের অবৈধ অর্থ পাচার। তদন্তে উঠে এসেছে, মঈনুল হাসানের স্ত্রী ফেরদৌসী শাহরিয়ার, যিনি ওয়াশিংটন দূতাবাসে কর্মরত ছিলেন, তার মাধ্যমেও অর্থ স্থানান্তর হয়েছে।

গ্রামে সুদের ব্যবসা ও আতঙ্কের রাজনীতি: নড়াইল জেলার লোহাগড়ায় অনুসন্ধানে জানা যায়, মঈনুলের পরিবার জড়িত সুদের ব্যবসা ও ভূমি দখল–সংক্রান্ত মামলায়।

স্থানীয় বিএনপি নেতাদের অভিযোগ—“তার পরিবার রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হয়ে সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে হামলা-মামলা করত; এলাকায় কেউ তাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পেত না। নিরপেক্ষ কর্মকর্তাদের অনেককে ওএসডি করা হচ্ছে, আবার আওয়ামী ঘনিষ্ঠদের পুনর্বাসন দেওয়া হচ্ছে।

সওজ ভবনের অভ্যন্তরে এখন দুই শ্রেণির বিভাজন— একদিকে মঈনুল-ঘনিষ্ঠ সুবিধাভোগীরা, অন্যদিকে বঞ্চিত কর্মকর্তারা।

সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরে আজও সংস্কারের বদলে পুনর্বাসনের হাওয়া বইছে। “কাদের চক্র” এখনো কার্যকর, এবং অভিযোগের পাহাড় থাকা সত্ত্বেও প্রধান প্রকৌশলী মঈনুল হাসানসহ সংশ্লিষ্টরা রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। দপ্তরের ভেতরের অনেক কর্মকর্তা আশঙ্কা করছেন—যদি এ চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে সওজে প্রশাসনিক অচলাবস্থা ও দুর্নীতির পুনরুত্থান অনিবার্য।

Link copied!