Noman Group Advertisement

ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে ৭২০ কোটি টাকা লুট

জাহাঙ্গীর আলম তপু , সহ-সম্পাদক

প্রকাশিত: ০৫ জুন, ২০২৫, ১১:৩২ পিএম

আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাব খাটিয়ে গড়ে তুলছেন অবৈধ সম্পদের পাহাড়, নামে বেনামে রয়েছে বাড়ী-গাড়ী ও শতকোটি টাকার অবৈধ সম্পদ এবং রাষ্ট্রের ৭২০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ। অনুসন্ধানে জানাগেছে, বান্দরবান জেলা পরিষদের ২য় শ্রেণীর কর্মকর্তা উসাজাই  মারমা স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার সাবেক মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং ও সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ক্যাশৈল্লার আস্থাভাজন হয়ে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন আওয়ামী লীগ সরকারের বিগত ১৬ বছরে। এই টাকায় গড়ে তুলেছেন অবৈধ সম্পদের পাহাড়।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, বান্দরবান সদরের মধ্যম পাড়া বৈদ্যগলিতে কোটি টাকা মুল্যের ৩ গন্ডা জমি, জমজম হোটেলের সামনে কয়েকটি দোকান, কোটি টাকার মূল্যের ঝমঝম হোটেল, শিল্পি গলিতে ৩ শতক জমি, রাংলাই বাড়ি এলাকায় মুল্যবান জমি, রোয়াংছড়ি স্টেশনে কোটি টাকার জমি, লেমুঝিড়ি আগা পাড়াতে ১ম শ্রেণীর ১৫ একর জমি ও ১০ একর সেগুন বাগান, মখন প্রজেক্ট, চড়ুই পাড়াতে ১০ একর পাহাড়ি জমি, উজিপাড়া প্রবেশ মুখে ২৪ শতক জমি, ঢাকা ধানমন্ডিতে ৫ কোটি টাকা মুল্যের ফ্লাটসহ দেশে বিদেশে অসংখ্য সম্পত্তির মালিক উসাজাই। ২য় শ্রেণীর চাকরি করেও সন্তান পড়াশোনা করছেন লন্ডনে। উপরের হিসাব মাত্র তার সম্পত্তির একাংশই। বান্দরবান, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও ঢাকায় বিভিন্ন ব্যাংকে রয়েছে নামে বেনামে শত শত কোটি টাকা ডিপোজিট। এছাড়াও তার আত্মীয়-সজন ও প্রিয় মানুষদের নিকট রেখেছেন শতশত কোটি নগদ টাকা।

মূলত দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে একই পদে বহাল আছে এই উসাজাই। প্রতিবছর পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রনালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রীর খাত থেকে বরাদ্দ পাওয়া অর্থ ও খাদ্যশষ্য পুরোটাই বণ্টন করতেন তিনি। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিগত ১৬ বছর ধরে প্রায় ৭২০ কোটি টাকার খাদ্যশস্য প্রকল্পের পুরোটাই ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে আত্মসাৎ করা হয়েছে। আর তার পেছনে রয়েছে হিসাব রক্ষক উসাজাইয়ের মূল ভূমিকা। অস্তিত্বহীন ও ভুয়া দেড় শতাধিক প্রকল্পের নামে এসব খাদ্যশস্য কাগজপত্রে বরাদ্দ দেখানো হয়। কিন্তু সরেজমিন গিয়ে প্রকল্পের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই লুটপাটের সঙ্গে জড়িত আছেন বান্দরবান জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ক্য শৈ ব্লা, নির্বাহী প্রকৌশলী জিয়াউর রহমান, উপসহকারী প্রকৌশলী থোয়াই চ মং, হিসাবরক্ষক উসাজাই মারমা। তবে অফিসের কেউ তাদের ভয়ে গণমাধ্যমে কাছে মুখ খুলতে চাননি। সাধারণত দাতব্য প্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মাদ্রাসা, মন্দির, গির্জা, রাস্তাঘাট সংস্কার ও ছোটখাটো ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের জন্য এই খাদ্যশস্য প্রকল্পগুলো সরকার দিয়ে থাকে।

 

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত গত ১৬ বছরে বান্দরবান জেলা পরিষদে খাদ্যশস্য প্রকল্পের চাল বরাদ্দ আসে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার টন এবং গমের বরাদ্দ আসে প্রায় ৮৬ হাজার টন। চাল আর গম মিলে খাদ্যশস্য প্রকল্পে বান্দরবান জেলা পরিষদে ১৬ বছরে বরাদ্দ এসেছে প্রায় ৭২০ কোটি টাকার। কিন্তু কাগজপত্রে সব ঠিক রেখে ভূতুড়ে প্রকল্প তৈরি করে এই বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য আত্মসাৎ করা হয়েছে। এইসব প্রকল্পের ২৫ থেকে ৩০ ভাগ পেতেন উসাজাই, বাকীটা ৪/৫ ভাগে ভাগ হতো।

 

সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা যায়, খাদ্যশস্যের এই প্রকল্পগুলো প্রায় পুরোটাই অস্থিত্বধীন। সাম্প্রতিক কয়েক বছরের প্রকল্পগুলো সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা যায়, লামা উপমেলার আজিজনগর ইউনিয়নের একটি প্রকল্প  হচ্ছে দুলালপাড়া থেকে বেলালপাড়া পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার। কিন্তু আজিজনগরে দুলালপাড়া আর বেলালপাড়া বলতে কোনো পাড়াই খুঁজে পাওয়া যায়নি এই ইউনিয়নে। পরে একই ইউনিয়নে জাহেদুলপাড়া পুকুর সংস্কার এবং ওয়াহেদুলপাড়া পুকুর সংস্কারের কাজ করার কথা বলা হয়, কিন্তু আজিজনগরে আহেদুলপাড়া আর ওয়াহেদুলপাড়া নামেরও কোনো পাড়ার খোঁজ পাওয়া যায়নি। পরে সরেজমিনে ফাইতংয়ের কামাইরণা ঝিরি থেকে চিউনিপাড়া রাস্তা সংস্কার আর ফাইতং আদিদংপাড়া রাস্তা সংস্কারের কাজ কতটুকু দেখার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এই ইউনিয়নে কামাইরখ্য ঝিরি থেকে চিউনিপাড়া সংস্কার করার মতো কোনো রাষ্ট্রই নেই এবং ফাইতং জাদিদংপাড়ায় বিগত কয়েক বছরে কোনো সংস্কার কাজ করা হয়নি। এভাবে লামা উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের ঠান্ডাঝিরি রাস্তা সংস্কার, ডলুঝিরি হতে রাবার বাগান রাস্তা সংস্কার, মরুঝিরি বাঁধ সংস্কার, ডেসটিনি বাগান থেকে লম্বাশিয়া রাস্তা সংস্কার এবং ২নং ওয়ার্ডের গরিব মহিলাদের মাঝে হাঁস-মুরগি ও ছাগল বিতরণসহ অসংখ্য প্রকল্প সরেজমিন তদন্ত করা হয়। ওইখানে সংস্কার কাজের অস্তিত্বই পাওয়া যায়নি। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার নয়াপাড়া ইউনিয়নের কলাকিরি ছাউনিপাড়া যাওয়ার রাস্তা সংস্কার, সদর ইউপির ১নং ওয়ার্ডে দুস্থ মহিলাদের মাঝে হাঁস-মুরগি বিতরণ। এখানে ছাউনিপাড়া নামে কোনো পাড়ার অভিত্ব পাওয়া যায়নি। এছাড়া সদর ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের দুস্থ মহিলাদের হাঁস-মুরগি বিতরণের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এভাবে বান্দরবান সদর উপজেলার জামছড়ি ইউনিয়নের কামদংপাড়া সামাজিক পুকুর সংস্কার, রোয়াংছড়ি রাস্তার মাথা থেকে সামুকঝিড়ি রাস্তা সংস্কার, কুহালং ইউনিয়নের ক্যমলংপাড়া শশ্মশানে যাওয়ার রাস্তা সংস্কারসহ দেড়শর বেশি প্রকল্প সরেজমিন তদন্ত করা হয়। কিন্তু কোনো কাজের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। কাগজপত্রে থাকলেও বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব নেই প্রকল্পগুলোর। এমনকি কিছু কিছু জায়গায় যাদের প্রকল্প চেয়ারম্যান দেখানো হয়েছে তাদেরও খুঁজে পাওয়া যায়নি। এ থেকে বোঝা যায়, খাদ্যশস্য প্রকল্পের পুরোটাই ভুয়া এবং ভুয়া স্থান ও ব্যক্তি দেখিয়ে লুটপাট ও আত্মসাৎ করা হয়েছে।

 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা পরিষদের এক কর্মকর্তা বলেন, নামে-বেনামে প্রকল্প সাজিয়ে মূলত লুটপাট করেছেন বান্দরবান জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। প্রকল্পগুলোর সরেজমিন কোনো অঙ্কিত্ব পাওয়া যাবে না। নিরাপত্তার স্বার্থে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জনপ্রতিনিধি বলেন, কোনো কর্মকর্তা যাতে তদন্ত করতে যেতে না পারেন সেজন্য বেশ কিছু প্রকল্প দুর্গম এলাকাগুলোতে দেখানো হয়েছে। যেখানে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার হেঁটে যেতে হয়। কোনো যানবাহন চলে না। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বান্দরবান জেলা পরিষদের হিসাবরক্ষক উসাজাই মারমা বলেন, হিসাবরক্ষক হিসেবে যতটুকু দায়িত্ব পালন করার ততটুকু করেছি। চেয়ারম্যান স্যারের অনুমতি ছাড়া আপাতত কিছু বলতে পারব না। আপনারা উনার সঙ্গে যোগাযোগ করেন।

 

প্রকল্প দেখভালের দায়িত্বে থাকা উপসহকারী প্রকৌশলী খোয়াই চ মং বলেন, প্রকল্পে আমি ছাড়াও আরও সহকর্মী দায়িত্বে ছিল। নিউজ করলে করেন। তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। এই বলে ফোন কেটে দেন খোয়াই চ মং। নির্বাহী প্রকৌশলী জিয়াউর রহমান বলেন, প্রকল্পগুলো আমি দেখি না। হিসাবরক্ষক উসাজাই আর সাব-ইঞ্জিনিয়াররা দেখেন। জেলা পরিষদের অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, এইসবকিছুর মূলহোতা হিসাবরক্ষক উসাজাই। উসাজাইকে পরিষদের সকল বিলের একটা পারসেনটিজ দিতে হয়। ২য় শ্রেণীর কর্মকর্তা হয়ে দেশে বিদেশে অগাধ

ভ্রমণ করেন উসাজাই। তার স্থাবর অস্থাবর প্রায় হাজার কোটি টাকার সম্পদ দৃশ্যমান। এছাড়াও তার কাছে সবসময় ২০-৫০ কোটি নগদ টাকা থাকে। ফ্যাসিস্ট আওয়ামীলীগ এর আমলে তার দূর্ণীতির অন্ত নেই। বর্তমানে সে একই জায়গায় বহাল তবিয়তে  চাকুরী করছেন। তার বিরুদ্ধে সঠিক তদন্ত করে তার সকল অবৈধ সম্পদ বয়জাপ্ত করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করা হোক। হিসাব ও নিরীক্ষা কর্মকর্তা মোঃ ওসমান গণি চৌধুরী জানান জেলা পরিষদের খাদ্যশস্যের বিষয়টি উসাজাই দেখভাল করতেন। এই বিষয়ে তিনি কিছু জানে না। উসাজাইয়ের অবৈধ সম্পত্তি অর্জনের বিষয়ে আনতে চাইলে তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি। এদিকে বান্দরবান জেলা বিএনপির পক্ষ থেকে সম্প্রতি জেলার ৪৩ জন দুর্নীতিবাজ চিয়িত করে জেলা প্রশাসককে দেওয়া তালিকায় উসাজাইয়ের নাম রয়েছে। 

 

 

Link copied!