রেজাউল করিম রেজা: বছর না ঘুরতেই গাইবান্ধার তিস্তা ও যমুনা নদীর তীর সংরক্ষণ প্রকল্পে নির্মিত বালুর বাঁধের অন্তত ৫২টি পয়েন্টে ধস দেখা দিয়েছে। পানির স্রোতে কংক্রিটের বোল্ডারও নদীতে ধসে পড়েছে। ফলে তীব্র ভাঙনের আতঙ্কে আশপাশের মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ স্থানে সরে যাচ্ছে। অথচ, প্রকল্পটির কাজ শেষ দেখিয়ে ৯৯৬ কোটি টাকার বেশি অর্থ উত্তোলন করে নিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা এমন তথ্য উঠে এসেছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সূত্রে।
প্রকল্পের পেছনের গল্প: ২০২৩-২৪ অর্থবছরে যমুনা ও তিস্তা নদীর তীর সংরক্ষণের জন্য কামারজানি থেকে গাইবান্ধার হরিপুর পর্যন্ত প্রায় ১৩ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বাঁধ নির্মাণ ও সংরক্ষণের প্রকল্প হাতে নেয় পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। দরপত্র অনুযায়ী কাজটি পায় পাবনার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান গোলাম রব্বানী কনস্ট্রাকশন তবে অভিযোগ রয়েছে, প্রকৃত ঠিকাদার কাজ না করে স্থানীয় একজন আওয়ামী লীগ নেতা এবং তার ঘনিষ্ঠ সাব ঠিকাদারদের মাধ্যমে কাজটি করিয়েছেন। প্রকল্পের শর্ত অনুযায়ী মাটি দিয়ে বাঁধ নির্মাণের কথা থাকলেও, বরং নদীর পাশ থেকে কেটে আনা বালু দিয়েই নির্মাণ করা হয়েছে পুরো বাঁধ। এতে বাঁধের কাঠামোগত স্থায়িত্ব দুর্বল হয়ে পড়ে।
নির্মাণে অনিয়ম: প্রকল্পের নিয়ম অনুযায়ী, প্রয়োজনে নদীর অন্তত ১০০ ফুট গভীরতা থেকে বালু সংগ্রহ করার কথা থাকলেও, ঠিকাদার ভেকু দিয়ে বাঁধের নিচ থেকেই মাটি কেটে নির্মাণ করেছেন। নদীর তীর সংরক্ষণের জন্য কংক্রিটের ব্লক বসানোর কথা থাকলেও, তা ছিল কেবল লোক দেখানো। অধিকাংশ জায়গায় ব্লকগুলো এখন পানিতে ধসে পড়েছে। তীব্র ভাঙন শুরু: চলতি বর্ষার শুরুতেই কাপাসিয়া, শ্রীপুর, হরিপুর, পুঠিমারী ও ফুলছড়িসহ বিভিন্ন এলাকায় নতুন নির্মিত বাঁধের অন্তত ৫২টি স্থানে ধস দেখা দেয়। এতে নদীর পাশের বিস্তীর্ণ জনপদ ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়েছে। বাঁধে চলাচল কঠিন হয়ে পড়েছে।
ভীতি ও প্রভাব: স্থানীয়দের অভিযোগ, কাজের গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন তুললে হুমকি-ধমকি দেওয়া হয়। সরকারি কাজে বাধা দিলে মামলা হবে। এ কাজ আওয়ামী লীগের বড় নেতার তদারকিতে হচ্ছে চুপচাপ দেখে যান, আমরা কাজ করছি। এভাবেই হুমকি দিয়ে অনিয়ম ঢাকার চেষ্টা করা হয় বলে অভিযোগ। দুর্নীতি ও টাকা ভাগবাঁটোয়ারা: দুদকের একাধিক সূত্র জানায়, গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. হাফিজুল হক, আওয়ামী লীগ নেতা ও সংশ্লিষ্ট সাব ঠিকাদার মিলে প্রকল্পের সিংহভাগ অর্থ ভাগবাঁটোয়ারা করে নিয়েছেন। কাজ দেখিয়ে প্রায় ৯৯৬ কোটি টাকা উত্তোলন করে সবাই পালিয়ে গেছেন। ফলে বাঁধ ধসে গেলেও তা মেরামতের কোনো কার্যকর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
প্রকৌশলীর বক্তব্য: নির্বাহী প্রকৌশলী মো. হাফিজুল হকের মোবাইল নাম্বারে বার বার বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি রিসিভ করেননি। বিশ্লেষণ: এ প্রকল্পটি দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী তীর সংরক্ষণ প্রকল্প হলেও, সেখানে দুর্নীতি ও অনিয়মের চিত্র ভয়াবহ। জনপদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা না করে কয়েকজন কর্মকর্তা ও ক্ষমতাবান ব্যক্তি লুটপাটে মেতে উঠেছেন। এত বিপুল অর্থ ব্যয়ের পরও বাঁধ টিকছে না এক বছরও। এতে একদিকে যেমন রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় হয়েছে, তেমনি হুমকির মুখে পড়েছে হাজারো মানুষের জীবন-জীবিকা।
আপনার মতামত লিখুন :