ফতুল্লা ডিপোতে ডিজেল চুরি: তেল টুটুলকে বাঁচাতে কোটি টাকার মিশন

নিজস্ব সংবাদদাতা , প্রতিদিনের কাগজ

প্রকাশিত: ০৯ অক্টোবর, ২০২৫, ০৫:২৫ পিএম

নারায়ণগঞ্জের  ফতুল্লা অবস্থিত যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের ডিপো থেকে সম্প্রতি ৩ লাখ ৭৮ হাজার ১৬৮ লিটার ডিজেল চুরির ঘটনা প্রকাশ পেয়েছে। এই ঘটনায় যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের পাশাপাশি  বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি)  জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করে। তবে  যমুনা অয়েলের দায়িত্বশীল অনেক কর্মকর্তার আশংকা,  তদন্ত কমিটি  প্রকৃত ঘটনা “ধামাচাপা দেয়ার মাধ্যমে অপরাধীদের পার পাওয়ার সুযোগ করে দেবে।  লক্ষনও দেখা দিয়েছে সেই রকমই।

এত বড় জালিয়াতির সাথে যে সকল কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে, এদেরকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয় তদন্ত কমিটিতে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যমুনার একাধিক কর্মকর্তা বলেন অভিযুক্তদের সাময়িক বরখাস্ত ছাড়া কোনো ভাবেই সুষ্ঠ তদন্ত সম্ভব নয়। সেসকল কর্মকর্তারা আরও বলেন দুদক, সেনাবাহিনী কিংবা বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তদন্ত কমিটি ব্যতিত সঠিক তদন্ত হওয়া সম্ভব নয়। এদিকে এই ঘটনার মুল হোতা জয়নাল আবেদীন টুটুলকে রক্ষা করতে কোটি টাকার মিশন নিয়ে মাঠে নেৃেছে চোরাই তেল সিন্ডিকেট সদস্যেরা। 

একদিকে যমুনা অয়েল কোম্পানীর কর্মকর্তাদের বিরুদ্বে তেল পাচারের অভিযোগ, অপরদিকে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন ( বিপিসি) নিয়মিত মাসোহারা পায় এই সিন্ডিকেট থেকে। ঘুরেফিরে এই দুই প্রতিষ্ঠানের তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে আগাম প্রশ্ন তুলেছে যমুনা অয়েলে কর্মরত অনেকেই৷ এদিকে কোন কারনে জালানি মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি ম্যানেজ হলেই পার পেয়ে যাবে অপরাধীরা।  জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির নেতৃত্বে আছেন অতিরিক্ত সচিব মো: আব্দুল মান্নান  (জ্বালানি)।

এই কমিটিকে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এদিকে  যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডও  আভ্যন্তরিন ভাবে দুটো  তদন্ত কমিটি গঠন করে।প্রথমটা করা হয় ২৮ সেপ্টেম্বর এবং দ্বিতীয়টা ৩০ সেপ্টেম্বর।  তবে নির্ধারিত সময়ে মধ্যে যমুনার কোন কমিটিই তদন্ত রিপোর্ট জমা দিতে পারেনি। এদিকে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন তদন্ত কমিটি গঠন  করে ২রা অক্টোবর। এ কমিটিও তদন্ত শেষ করতে পারেনি।  প্রশ্ন উঠেছে তাদের তদন্তে নিরপেক্ষতা নিয়েও। 

অনুসন্ধানে জানা গেছে এই বিশাল পরিমান ডিজেল চুরির নেপথ্যের নায়ক জয়নাল আবেদিন টুটুল পদবি: অপারেটর (গ্রেজার)।  পুরো ফতুল্লা ডিপাতে তিনটি গ্রেজার পদ থাকলে টুটুল একাই তিনটি পদের দায়িত্ব পালন করছে । তেল সিন্ডিকেটে  তার একক নিয়ন্ত্রন ধরে রাখতে অন্য কাউকে এই ডিপোতে গ্রেজার পদে পোষ্টিং দেয়া হয়নি। অর্থ্যাৎ বিশাল এই ডিপোতে তেল পরিমাপের একমাত্র লোক  তেল টুটুল। তবে নিজে উপস্থিত থাকেনা, তারই অধীনস্থ এবং সিন্ডিকেট সদস্য ক্যাজুয়েল শ্রমিক  দিয়েই তেলের পরিমাপ নির্ধারন করে থাকে ।

তিনটি হত্যা মামলার আসামি তেল টুটুল ফতুল্লা ডিপোর “গদফাদার” হিসেবেই পরিচিত । টানা সতের বছর ধরে তেল টুটুলের নেতৃত্বই চলছে ফতুল্লা ডিপোর চোরাই তেল সিন্ডিকেটটি। একাধিক সুত্রে জানা গেছে ৪ অক্টোবর ২০২৫ (পূজার ছুটির দিন) টুটুল কালো গ্লাসের গাড়িতে  ডিপোতে প্রবেশ করে, উপস্থিত কর্মচারীদের হুমকি দেয়—“ উপরের মহল ম্যানেজ, কেউ যেন মুখ না খোলে। এদিকে বিপিসির তদন্ত কমিটি ডিপোতে গেলেও স্থানীয় কর্মচারীদের সঙ্গে কথা না বলেই ফিরে যান। অবশ্য বিপিসির কর্মকর্তাদের অনেকে আগে থেকেই টুটুলের সাথে ম্যানেজ। 

 তেল টুটুল ফেঁসে গেলে অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাই ফেঁসে যাবে। এরকম তালিকায় আছে ডিজিএম অপারেশন হেলাল উদ্দিন, এজিএম ডিপো অপারেশন শেখ জাহিদ আহমেদ, ফতুল্লা ডিপো ইনচার্জ আসলাম খান আবু উলায়ী ও ফতুল্লা ডিপোর ক্যালিব্রেটর কর্মকর্তা নুরুল হক৷ অভিযোগ উঠেছে এদের দ্বারাই সংগঠিত হয়েছে এত বড় জালিয়াতির ঘটনা। যেকারনে টুটুলকে রক্ষা করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে এই চক্রটি 

  নিজেদের বাঁচাতে ক্যালিব্রেশন বা পরিমাপ ত্রুটিকে ব্যবহার করার কৌশল হিসাবে বেছে নিয়েছে । শেষ পর্যন্ত হবেও তাই, চালিয়ে দেয়া হবে ক্যালিব্রেশনে সমস্যার কথা বলেই। তবে এই ঘটনায় থেমে নেই বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। ইতিমধ্যে মাঠে নেমেছে দুদক। তারই ধারাবাহিকতায় গতকাল  ৮ অক্টোবর দুপুর থেকে অভিযান চালায় যমুনা অয়েলের পতেঙ্গায় অবস্থিত টার্মিনাল অফিসে।

অভিযানের নেতৃত্বে দেয় দুদক সমন্বিত কার্যালয় চট্টগ্রাম -১ সহকারী পরিচালক সাইদ মোহাম্মদ ইমরান। দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তাদের কাছ থেকে তেল সরবরাহ সংক্রান্ত রেকর্ড পত্র তলব করে। টার্মিনালের এজিএম ( টার্মিনাল)  মোহাম্মদ মাকছুদুর রহমান সংশ্লিষ্ট রেকর্ড পত্র টীমের হাতে তুলে দেন। পরবর্তীতে যমুনা অয়েল আগ্রাবাদ প্রধান কার্যালয়ে তদন্ত কমিটির সদস্যদের বক্তব্য নেয়া হয়, তলব করা হয় সংশ্লিষ্ট রেকর্ড পত্র । জেলা সমন্বিত কার্যালয় - ১ উপ পরিচালক মো: সুবেল আহমেদ গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছে  দুদক প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে । তিনি আরো  জানান কমিশন বিষয়টি পর্যালোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে৷

Link copied!