Noman Group Advertisement

তিস্তা সেতু রক্ষা বাঁধে ধস, বাড়ছে ভাঙন আতঙ্ক

নিজস্ব সংবাদদাতা , প্রতিদিনের কাগজ

প্রকাশিত: ১৪ আগস্ট, ২০২৫, ০৯:৪৪ এএম

ছবি: সংগৃহীত

তিস্তা সেতুর রক্ষা বাঁধ ধসে পড়ায় হাজারো পরিবার ও রংপুর–লালমনিরহাট সড়ক ঝুঁকিতে

রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার মহিপুরে তিস্তা নদীর ওপর নির্মিত দ্বিতীয় সড়ক সেতুর পশ্চিম তীরে সেতু রক্ষা বাঁধের প্রায় ৬০ মিটার এলাকা ধসে পড়েছে। এতে প্রায় ৭০ ফুট গভীর গর্তের সৃষ্টি হয়েছে।

গত কয়েকদিন ধরে পানি বৃদ্ধি ও তীব্র স্রোতের কারণে লালমনিরহাট–রংপুর সড়কসহ পার্শ্ববর্তী হাজারের বেশি পরিবারের বসতবাড়ি চরম ঝুঁকিতে রয়েছে।

বুধবার (১৩ আগস্ট) সরেজমিনে দেখা গেছে, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল এবং অব্যাহত বৃষ্টিপাতের ফলে তিস্তা নদীর পানি দ্রুত বাড়ছে। এতে সেতুর পশ্চিম পাশের প্রায় ৯০০ মিটার দীর্ঘ রক্ষা বাঁধের বিভিন্ন অংশে আঘাত হানছে স্রোতের তীব্র ধাক্কা। বাঁধের নিচের মাটি সরে গিয়ে ব্লকগুলো ভেঙে পড়ছে এবং বাকিগুলোও ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে।

স্থানীয়দের আশঙ্কা, দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে পুরো বাঁধ ধসে গিয়ে সেতু ও যোগাযোগ ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

মহিপুর এলাকার বাসিন্দা শরিফুল ইসলাম বলেন,
“গত দুই বারের বন্যায় বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এবার পানি বাড়তেই বাঁধের ৬০ মিটার ধসে বিশাল গর্ত হয়েছে। তিন গ্রামের প্রায় হাজারখানেক পরিবার ও সেতুটি এখন বিপদে।”

আরেক বাসিন্দা আনসার আলী বলেন,
“নদীর পানি ওঠা–নামায় বাঁধ ভাঙছে, জমিও ভেঙে যাচ্ছে। কবে থেকে শুনছি তিস্তা প্রকল্প হবে, কিন্তু কিছুই হয় না।”

২০১৮ সালে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (LGED) প্রায় ১২১ কোটি টাকা ব্যয়ে এই দ্বিতীয় সড়ক সেতুটি নির্মাণ করে, যা রংপুর ও লালমনিরহাট জেলার মধ্যে যোগাযোগ সহজ করেছে। তবে বাঁধ রক্ষায় ব্যবস্থা না নিলে পুরো সেতুই ঝুঁকিতে পড়বে।

লক্ষ্মীটারী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল হাদী বলেন,
“দুইবার আমরা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলাম, কিন্তু কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এবারও উজানে বৃষ্টি হলে বাঁধ ভেঙে গিয়ে পানি সরাসরি রংপুর–লালমনিরহাট সড়কে আঘাত করতে পারে। এতে ৩০ লাখ মানুষের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার আশঙ্কা আছে।”

পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তারা ফোন রিসিভ করেননি, ফলে ভাঙন রোধে কোনো জরুরি উদ্যোগ নেওয়া হবে কি না—তা জানা যায়নি।


তিস্তার পানি বৃদ্ধি ও প্লাবন: হাজারো পরিবার পানিবন্দি

তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করায় রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলার তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল, চর ও দ্বীপচরের বহু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ফলে নদীপাড়ের মানুষজন বন্যার আশঙ্কায় ভুগছেন।

লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের পশ্চিম ইচলী গ্রামের কুমোবালা বলেন,
“সকাল থেকে বাড়িতে পানি উঠতে শুরু করে। এর আগে দুই দিন পানি ছিল, কিন্তু কোনো সহায়তা পাইনি।”

গঙ্গাচড়া উপজেলার নোহালী, আলমবিদিতর, কোলকোন্দ, লক্ষ্মীটারী, গজঘন্টা ও মর্ণেয়া ইউনিয়ন এবং কাউনিয়া উপজেলার বালাপাড়া, টেপামধুপুর ইউনিয়ন ও পীরগাছা উপজেলার ছাওলা ইউনিয়নের বিভিন্ন চর ও নিম্নাঞ্চলে পানি ঢুকে পড়েছে। অনেকে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন।

কোলকোন্দ ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান শরিফুল ইসলাম জানান,
“বিনবিনা, শখের বাজার, খলাইর চর, মটুকপুর, আবুলিয়া, চিলাখালসহ বিভিন্ন এলাকায় মানুষ পানিবন্দি।”

বিনবিনা গ্রামের জামাল মিয়া বলেন,
“রাতে পানি ছিল না, সকাল থেকে পানি বাড়তে বাড়তে দুপুরেই ঘরে ঢুকে পড়ে। গরু-বাছুর নিয়ে খুব বিপদে পড়েছি।”

মর্ণেয়া ইউনিয়নের আনছারটারী এলাকার আলেফ উদ্দীন বলেন,
“বসতবাড়ি ডুবে গেছে, পশুদের চারণভূমিও পানির নিচে। ফলে পশু খাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে।”

মর্ণেয়া ইউপি সদস্য মজমুল হক ভেগল বলেন,
“ভাঙাগড়া চর, তালপট্টি নরসিং, নিলারপাড়ায় দুই শতাধিক বাড়িতে পানি ঢুকেছে।”

নোহালী ইউপি চেয়ারম্যান আশরাফ আলী বলেন,
“চর নোহালী, চর বাগডহরা, চর বৈরাতি, মিনার বাজার, ব্রিফ বাজার ও আশ্রয়ণ বাজার এলাকায় পানিবন্দি মানুষ কষ্টে আছে।”

গঙ্গাচড়ার ইউএনও মাহমুদ হাসান মৃধা বলেন,
“নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে সহায়তা দিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”


ছাওলায় ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন

পীরগাছার ছাওলা ইউনিয়নের শিবদেবসহ আশপাশের এলাকায় সাম্প্রতিক ভাঙনে শতাধিক ঘরবাড়ি তিস্তার গর্ভে বিলীন হয়েছে। শুধু শিবদেব গ্রামেই ৪৯টি বসতবাড়ি, একটি ইবতেদায়ি মাদ্রাসা এবং একটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নদীগর্ভে হারিয়ে গেছে।

ক্ষতিগ্রস্তদের অনেকে আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে মঙ্গলবার ৩০টি পরিবারকে এক বান্ডিল ঢেউটিন ও ৩ হাজার টাকা করে সহায়তা দেওয়া হয়।

ক্ষতিগ্রস্ত মোজাফ্ফর হোসেন বলেন,
“সব হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে আছি। তবে এই সহায়তায় অন্তত সাময়িকভাবে থাকার ব্যবস্থা করতে পারব।”


দীর্ঘমেয়াদি প্রতিরোধ ব্যবস্থা চায় মানুষ

স্থানীয়রা বলছেন,
“সাময়িক সহায়তা জরুরি হলেও, স্থায়ী ভাঙন প্রতিরোধ ব্যবস্থা না হলে প্রতিবছরই একই ক্ষতির মুখে পড়তে হবে।”


বন্যা পূর্বাভাস ও বৃষ্টিপাত পরিস্থিতি

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র (বাপাউবো) জানিয়েছে,

  • বুধবার ও বৃহস্পতিবার তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীবেষ্টিত অঞ্চলে বন্যার ঝুঁকি রয়েছে।

  • ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও পদ্মা অববাহিকার নদ-নদী সতর্ক সীমায় প্রবাহিত হতে পারে।

  • পদ্মা নদীসংলগ্ন নিম্নাঞ্চল সাময়িকভাবে প্লাবিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন,
“মঙ্গলবার পঞ্চগড়ে ২০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। সেই সঙ্গে উজানে ভারতের আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে ভারী বৃষ্টি হয়েছে। বুধবারও পুরো রংপুর বিভাগে ও উজানে দিনভর বৃষ্টিপাত হয়েছে।”

Link copied!