যমুনা অয়েলে ছয়জনের অন্ধকার সাম্রাজ্য

নিজস্ব সংবাদদাতা , প্রতিদিনের কাগজ

প্রকাশিত: ০১ নভেম্বর, ২০২৫, ০৮:০৯ পিএম

ফাইল ছবি

মোস্তফা সারোয়ার : দেশের জ্বালানি তেল আমদানি ও সরবরাহের একমাত্র রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। এর অধীনে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা অয়েল কোম্পানি তেল বিক্রি করে থাকে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম, ঘুষ বাণিজ্য ও তেল চুরির অভিযোগ উঠেছে যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডে।

সম্প্রতি ফতুল্লা ডিপো থেকে পৌনে চার লাখ লিটার ডিজেল গায়েবের ঘটনা পুরো খাতকে নাড়িয়ে দিয়েছে। এই ঘটনায় চারটি তদন্ত কমিটি গঠন হলেও, কোনো কমিটিই এখনো প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি।

 

সিন্ডিকেটের শাসন: 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, যমুনা অয়েলে দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে একটি শক্তিশালী দুর্নীতি সিন্ডিকেট সক্রিয়। নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি থেকে শুরু করে তেল চুরির প্রতিটি প্রক্রিয়া এই সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে।

সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে রয়েছেন—হেলাল উদ্দিন (ডিজিএম, অপারেশন), মো. মাসুদুল ইসলাম (জিএম, মানবসম্পদ),

শেখ জাহিদ আহমেদ (এজিএম, অপারেশন-ডিপো),

মোহাম্মদ আসলাম খান আবু উলায়ী (ইনচার্জ, ফতুল্লা ডিপো),

মুহাম্মদ এয়াকুব (সাধারণ সম্পাদক, শ্রমিক ইউনিয়ন) ও

জয়নাল আবেদীন টুটুল (সভাপতি, শ্রমিক ইউনিয়ন)। এই ছয়জনের বিরুদ্ধে তেল চুরি, অবৈধ সম্পদ গঠন ও প্রশাসনিক প্রভাব খাটানোর অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে।

তদন্তে প্রভাব ও ধীরগতি : 

দুই সিবিএ নেতা মুহাম্মদ এয়াকুব ও জয়নাল আবেদীন টুটুলের শত কোটি টাকার সম্পদের উৎস অনুসন্ধানে বিপিসি ৮ অক্টোবর দুটি পৃথক কমিটি গঠন করে। তবে নির্ধারিত সময় শেষ হলেও কোনো প্রতিবেদন জমা পড়েনি। তদন্তে দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রভাব খাটানো ও তদন্ত বিলম্বিত করার অভিযোগ উঠেছে। সিন্ডিকেটের শীর্ষ দুই সদস্য—জিএম এইচআর মো. মাসুদুল ইসলাম ও ডিজিএম অপারেশন হেলাল উদ্দিন নিয়মিতভাবে তদন্তে প্রভাব বিস্তার করছেন বলে অভিযোগ করেছেন বিপিসির অভ্যন্তরীণ সূত্র।

 

পদোন্নতিতেও দুর্নীতি : 

২৩ অক্টোবর অনুষ্ঠিত যমুনা অয়েলের পদোন্নতি সভায় অভিযুক্ত দুই কর্মকর্তা শেখ জাহিদ আহমেদ ও আসলাম খান আবু উলায়ীর নাম প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের উপসচিব আসমা আরা বেগমের আপত্তিতে তাদের পদোন্নতি স্থগিত করা হয়।

 

ফার্নেস অয়েল কেলেঙ্কারি:  ২০১৪ সালে ফার্নেস অয়েল আমদানির সময় যমুনা অয়েলের ডিপো ইনচার্জ ছিলেন হেলাল উদ্দিন। অভিযোগ, তিনি বিপিসির তৎকালীন কর্মকর্তা ও বর্তমান এমডি মোস্তফা কুদরতে ইলাহী-এর সহযোগিতায় লাখ লাখ লিটার কালো তেল চুরি করে বিক্রি করেন। হেলাল উদ্দিন হিসাবের কারসাজি করে “অপারেশন লস” ১ শতাংশের নিচে দেখিয়ে তেল আত্মসাৎ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

 

দুদক ও গোয়েন্দা সংস্থার নজর: 

এখন যমুনা অয়েলের এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে নড়েচড়ে বসেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা।

দুদক ইতোমধ্যে সিন্ডিকেট সদস্যদের সম্পদ, ব্যাংক হিসাব, তেল আমদানি-রপ্তানি ও ক্রয় প্রক্রিয়া যাচাই শুরু করেছে। প্রাথমিক তদন্তে একাধিক কর্মকর্তার অঘোষিত সম্পদ, অবৈধ লেনদেন ও অর্থপাচারের তথ্য পাওয়া গেছে। গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, যমুনা অয়েলের কিছু কর্মকর্তা ও শ্রমিক নেতা বিদেশে সম্পদ গঠন ও প্রভাবশালী চক্রের অর্থ বিনিয়োগে যুক্ত। দীর্ঘদিনের সিন্ডিকেট রাজত্বে জর্জরিত যমুনা অয়েল কোম্পানি এখন রাষ্ট্রীয় সম্পদের বড় একটি লুটের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

তবে দুদক ও গোয়েন্দা সংস্থার সক্রিয় তৎপরতায় আশা জাগছে—অবশেষে তেলচোর ও দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট আইনের আওতায় আসবে।

Advertisement

Link copied!