দেশের অন্যতম বেসরকারি ব্যাংক ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডের (ইবিএল) চেয়ারম্যান মো. শওকত আলী চৌধুরী ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে প্রায় ৮ হাজার ৪০৭ কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেন ও অর্থপাচারের অভিযোগে তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
দুদকের মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ বিভাগ ইতোমধ্যে প্রাথমিক অনুসন্ধান শুরু করেছে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো থেকে নথি সংগ্রহ করছে। ২০২৫ সালের ২০ অক্টোবর কমিশনের বৈঠকে এই অনুসন্ধানের অনুমোদন দেওয়া হয়।অভিযোগ অনুযায়ী, গত এক দশকে শওকত আলী ও তার পরিবারের সদস্যরা ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস, দুবাই, সিঙ্গাপুর ও যুক্তরাজ্যে একাধিক শেল কোম্পানির মাধ্যমে বিপুল অর্থ বিদেশে স্থানান্তর করেছেন।
বিএফআইইউ–এর প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে শওকত আলী, স্ত্রী তাসমিয়া আমবারিন, মেয়ে জারা নামরিন ও ছেলে জারান শওকত আলী চৌধুরী—এই চারজন দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে ১৮৭টি হিসাব পরিচালনা করেন। এসব হিসাবে ৮,৪০৭ কোটি টাকা জমা ও ৮,২৪৭ কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়েছে।
তদন্তে আরও জানা গেছে, শওকত আলী ব্যাংক কোম্পানি আইনের সীমা অতিক্রম করে ইবিএলের ১৫ শতাংশ শেয়ার নিজের নামে ও শেল কোম্পানির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করছেন। দুদক এই শেয়ারগুলোর মালিকানা যাচাইয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএফআইইউকে যুক্ত করেছে।
এছাড়া, তার মালিকানাধীন এসএন করপোরেশন লিমিটেড–এর এলসি লেনদেনে একাধিক অসঙ্গতি ধরা পড়েছে। বেশ কয়েকটি এলসি ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসে নিবন্ধিত ‘শেল কোম্পানি’র নামে খোলা হয়, যেগুলোর ঠিকানা ও নিবন্ধন তথ্য প্রায় এক—যা আন্তর্জাতিকভাবে অর্থপাচারের স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়।
দুদক সূত্র জানায়, অভিযোগ দাখিলের পরপরই শওকত আলীর পরিবার বিদেশে সম্পদ বিক্রির চেষ্টা করে। এর মধ্যে দুবাইয়ের লানসি আইল্যান্ডে ৩০০ কোটি টাকার বিলাসবহুল ভিলা বিক্রির উদ্যোগ ছিল সবচেয়ে আলোচিত। দুদকের ধারণা, এটি ছিল অর্থপাচারের প্রমাণ গোপনের কৌশল। মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের আওতায় গত ১ জুলাই থেকে শওকত আলী ও তার পরিবারের সব ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। তদন্তে প্রাথমিকভাবে কিছু লেনদেনকে ‘অত্যন্ত সন্দেহজনক’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যাচাই–বাছাই শেষে আনুষ্ঠানিক মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছে দুদক।
বিষয়টি নিয়ে শওকত আলী চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে ইবিএলের এক মুখপাত্র বলেন, “ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের আর্থিক কার্যক্রম নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হয়। ব্যক্তিগত লেনদেনের দায় ব্যাংকের নয়। অর্থনীতি ও দুর্নীতিবিরোধী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ঘটনা বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের সুশাসনের ওপর নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ড. হুমায়ুন কবির বলেন, “একজন ব্যাংক চেয়ারম্যানের পরিবারের বিরুদ্ধে এত বড় অঙ্কের মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগ ব্যাংকিং ব্যবস্থার জন্য ভয়াবহ সতর্কবার্তা। দুদক যদি এই তদন্ত সফলভাবে শেষ করতে পারে, তবে এটি হবে ব্যাংক খাতে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার এক ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত।”
আপনার মতামত লিখুন :