পাতিচখা: চা শ্রমিকের শ্রমঘামে জন্ম নেওয়া মুখরোচক ঐতিহ্য

মোঃ আব্দুস সামাদ আজাদ , মৌলভীবাজার জেলা সংবাদদাতা

প্রকাশিত: ১০ নভেম্বর, ২০২৫, ০৪:৫৪ পিএম

চা বাগানের সবুজ ঢালু টিলাগুলোয় যখন সূর্যের আলো নরম পরশে ঝলমল করে, তখনই দেখা যায় মাথায় ঝুড়ি, পরনে মলিন শাড়ি, হাতে কাঁচি—একদল নারী-পুরুষের ব্যস্ত আনাগোনা। এরা চা শ্রমিক। সকাল গড়াতেই এই পরিশ্রমী মানুষগুলো নেমে পড়েন জীবিকার যুদ্ধে—কখনো রোদে, কখনো বৃষ্টিতে, কখনো কাদা মাড়িয়ে। সবুজ টিলার বুক থেকে তোলা হয় দুটি পাতা একটি কুঁড়ি—দেশের অন্যতম রপ্তানি পণ্যের কাঁচামাল। কিন্তু এর পেছনের গল্পটা ততটা রঙিন নয়। সকাল সকাল ঘরকন্নার কাজ সেরে, অল্প আহার মুখে দিয়ে বা কখনো আহার ছাড়াই, তারা ছুটে আসেন বাগানে। সকাল আটটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত টানা কাজ—সপ্তাহে ছয় দিনই এমন রুটিন।

কাজের ফাঁকে আসে একটিমাত্র বিরতি—মধ্যাহ্নভোজের সময়। ক্লান্ত শরীর একটু বিশ্রাম চায়, আর পেট খোঁজে খাবার। কিন্তু এই শ্রমজীবীদের পাতে দামি খাবার ওঠে না কোনোদিনই। যা জোটে, তা-ই তাদের বিলাস। তবে এই সাধারণ খাবারের মধ্যেও লুকিয়ে আছে এক অসাধারণ ঐতিহ্য ‘পাতিচখা’, চা পাতার কচি কুঁড়ি দিয়ে তৈরি এক অনন্য ভর্তা। আমরা চায়ের পাতা বলতে যা বুঝি, তা মূলত পানীয় তৈরির উপকরণ। কিন্তু মৌলভীবাজারের চা শ্রমিকরা চায়ের কচি পাতা দিয়ে বানান এক মুখরোচক ভর্তা—পাতিচখা।

মাজদিহি চা বাগানের নারী শ্রমিক বাসন্তী, কুন্তি ও সরস্বতী জানালেন—"আমরা সকালের খাবার করে বা না করে কাজ করতে যাই। দুপুরে বিশ্রামের সময় রুটি, মুড়ি বা চালভাজার সঙ্গে চায়ের কুঁড়ি পাতা ডলে বানাই পাতিচখা। এটাই আমাদের সবচেয়ে প্রিয় খাবার।"

একজন শ্রমিক অন্যদের কাছ থেকে রুটি, মুড়ি, পেঁয়াজ, মরিচ, লবণ, রসুন, সেদ্ধ আলু ইত্যাদি জোগাড় করেন। তারপর সবাই মিলে একটি পাত্রে মেশান এসব উপকরণ। শেষমেশ চা গাছের কচি পাতা হাতের তালুতে ডলে মিশিয়ে তৈরি হয় পাতিচখা—এক ঝাঁঝালো অথচ তৃপ্তিদায়ক ভর্তা। তারপর হাতে হাতে ভাগ হয় সেই খাবার, আর শুরু হয় দুপুরের ক্ষণিক ভোজন উৎসব।

দুপুরের রোদে যখন টিলা গরম হয়ে ওঠে, পাতিচখার ঝাঁঝ মেশানো গন্ধ তখন যেন শরীর-মনকে নতুন করে জাগিয়ে তোলে। শ্রমিকরা বলেন, "পাতিচখা খেলে ক্লান্তি কেটে যায়, আবার কাজ করার শক্তি পাই।" রুটির সঙ্গে কাঁচা চা পাতা মিশিয়ে খাওয়ার পর তাদের দেহে নব উদ্দীপনা তৈরি হয়। তাই প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই অভ্যাস টিকে আছে আজও।

বিশেষজ্ঞদের মতে, চা জনগোষ্ঠীর আদি পেশা ছিল কৃষিকাজ। উনিশ শতকের মাঝামাঝি, ১৮৪০ সালের দিকে, সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে চায়ের চাষ শুরু হয়। ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এনে এই আদি জনগোষ্ঠীকে নিযুক্ত করা হয় চা বাগানের কাজে। মধ্যাহ্নে রুটি খাওয়ার প্রথা তাদের পূর্বপুরুষদের গ্রামীণ জীবনের উত্তরাধিকার। পরে চা গাছের পাতার সংস্পর্শে এসে শ্রমের ক্লান্তি দূর করতে তারা রুটির সঙ্গে কচি পাতা মেশানো শুরু করেন যা সময়ের পরিক্রমায় হয়ে ওঠে ‘পাতিচখা’।

আজও মৌলভীবাজার, শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জের বাগানগুলোয় দুপুরের দিকে শ্রমিকদের দলকে দেখা যায় পাতা ডলতে, রুটি ছিঁড়ে খেতে, হাসতে। তাদের কাছে পাতিচখা শুধু খাবার নয়—এটা এক ঐতিহ্য, এক প্রাণের গল্প, যা চা বাগানের মাটির গন্ধের সঙ্গে মিশে গেছে। সবুজ চা বাগানের মনোরম দৃশ্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে কঠোর শ্রম, অদম্য প্রাণশক্তি এবং এক গভীর সংস্কৃতির ছাপ। পাতিচখা শুধু চা শ্রমিকের খাবার নয়—এটি তাদের জীবনযাত্রার প্রতীক, টিকে থাকার এক চিরসবুজ কাহিনি।

Link copied!